

বৃহস্পতিবার ● ২৪ এপ্রিল ২০২৫
প্রথম পাতা » আলোকিত ব্যক্তিত্ব » লোকসংস্কৃতি গবেষক আবু সালেহ আহমদ এর ধারাবাহিক গ্রন্থ আলোচনা-০৩ ভালোবাসার বহিরাবরণ: গ্রন্থটি সমাজ, প্রেম ও মানবজীবনের প্রতিচ্ছবি..। আলোচক- কবি এম আর ঠাকুর।
লোকসংস্কৃতি গবেষক আবু সালেহ আহমদ এর ধারাবাহিক গ্রন্থ আলোচনা-০৩ ভালোবাসার বহিরাবরণ: গ্রন্থটি সমাজ, প্রেম ও মানবজীবনের প্রতিচ্ছবি..। আলোচক- কবি এম আর ঠাকুর।
বজ্রকণ্ঠ ::::
লোকসংস্কৃতি গবেষক আবু সালেহ আহমদ এর ধারাবাহিক গ্রন্থ আলোচনা-০৩
ভালোবাসার বহিরাবরণ: গ্রন্থটি সমাজ, প্রেম ও মানবজীবনের প্রতিচ্ছবি..।
আলোচক- কবি এম আর ঠাকুর।
ভালোবাসার বহিরাবরণ:
লেখক - আবু সালেহ আহমদ।
প্রকাশক -পান্ডুলিপি প্রকাশন, সিলেট
প্রকাশকাল - ২০১৫।
মূল্য -১২০ টাকা
আবু সালেহ আহমদ শুধু একজন গল্পকার নন, তিনি একাধারে সমাজ-চিন্তক, লোকসংস্কৃতি গবেষক ও প্রাবন্ধিক। মানবিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী এক সাহিত্যসাধক-সেবকও বটে। তাঁর গল্পগ্রন্থ “ভালোবাসার বহিরাবরণ” পাঠকের সামনে একটি চলমান সমাজচিত্র তুলে ধরে, যেখানে প্রেম, যুদ্ধ, নারীর অধিকার, শ্রমিকের সংগ্রাম, যৌতুকপ্রথা ও পারিবারিক বন্ধনের মতো বাস্তব বিষয়ের যুক্ত করেছেন গভীর মানবিকমূল্যবোধ দিয়ে।
এই গ্রন্থের দশটি ছোটগল্প যেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের বাস্তবতাকে আয়নার মতো প্রতিফলিত করে।গল্প আপনাকে আকর্ষণ করবে নিঃসন্দেহে। খ্যাতনামা গল্পকারদের মতোই তাঁর গল্প গুলো যেন শেষহয়েও হয়না
প্রথমেই বলা যায় “মুক্তিযুদ্ধের গল্প” প্রসঙ্গে। লেখক এখানে মাখালকান্দি গ্রামের বর্বর ইতিহাসের এক বাস্তব ও হৃদয়স্পর্শী চিত্র আঁকেন। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের বর্তমান অবস্থা এবং যারা যুদ্ধের সময় লুটপাট, ধর্ষণ, ও হত্যা করেছিল তাদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। রাজাকারের সন্তানের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের বিবাহের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়ে লেখক সমাজের নৈতিক অবস্থান তুলে ধরেছেন
যা সত্যি অপূর্ব ।
“প্রেমের জন্য” গল্পে প্রেমের স্বীকৃতি না পাওয়ার ফলে এক যুগল আত্মহননের পথ বেছে নেয়—এ ঘটনা লেখক কেবল উপস্থাপনই করেননি, বরং আত্মহত্যার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে প্রেমের বাস্তব ও সত্য দর্শনের বার্তা দিয়েছেন। প্রেম যে আত্মত্যাগ নয়, বরং বেঁচে থেকে সমাজের মুখোমুখি হয়ে হয়। প্রেম যে বাহিরের আবরণ তা তাঁর বক্তব্যে গভীরভাবে ফুটে উঠেছে।
“মারুফার ভালোবাসা” গল্পে ধর্ষণ, বাল্যবিবাহ, স্বামীর জুয়াসক্তি ও নির্যাতনের করুণ চিত্র নিখুঁতভাবে চিত্রিত করেছেন লেখক। এক নিম্নবিত্ত নারীর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে লেখক দেখিয়েছেন সমাজে নারীর স্ব চিত্র অবস্থান, সেই সাথে প্রেমের নামে হওয়া ছলনার সম্পর্ক,যা সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে তাঁর সার্থক প্রতিবাদ ।
“দুই বান্ধবীর প্রেম” গল্পে প্রেমের নামে প্রতারণা ও দাম্পত্য বিচ্ছেদের করুণ পরিণতি তুলে ধরার পাশাপাশি লেখক সংসার টিকিয়ে রাখার গুরুত্ব ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার শিক্ষা দিয়েছেন।
“রহিমার কষ্ট” গল্পে যৌতুক, শিশুর অবহেলা ও পরিণতিতে পোলিও রোগ—এই সব বাস্তবতার ঘটনা লেখক এতটা আন্তরিকভাবে তুলে ধরেছেন তাযেন, সমাজের মানুষকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। দ্বিতীয় বিয়ের মাধ্যমে এক নারীর প্রতি অবহেলা, তার দুঃখ-বেদনার ভাষ্য লেখকের কলমে পেয়েছে সুস্পষ্টতা।
“ভুল বুঝে” গল্পে দেখা যায়, শ্রমজীবী মানুষের ওপর মহাজন ও সর্দার শ্রেণির শোষণের নগ্ন রূপ। এই গল্পটি আজকের দিনেও শ্রমিক অধিকারের প্রশ্নে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। লেখক সত্যিসত্যিই প্রশংসার দাবিদার।
এই গল্পগুলোর ভাষা সরল, কিন্তু বক্তব্য তীব্র ও তীক্ষ্ণ।বলা যায় সুকৌশলে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন। গল্পের প্রতিটি চরিত্রই যেন জীবন্ত। যাদের নিয়ে গল্পের বাস্তবতা রুপ দিয়েছেন, তাদের ব্যথা, চাহিদা ও প্রতিবাদ যেন পাঠকের মনে নাড়া দেয়।প্রতিশ্রুতিশীল বহুমাত্রিক লেখক আবু সালেহ আহমদের গল্প বলার কৌশল সুপরিমিত অথচ গভীর। যেখানে লোকসংস্কৃতি, আঞ্চলিক ভাষা, ও গ্রামীণ জীবনের সরলতা মিশে এক অসাধারণ আবহ তৈরি করেছে।
তাঁর লেখনী আমাদের মনে করিয়ে দেয়—সাহিত্য কেবল কল্পনার জগৎ নয়, এটি বাস্তবের প্রতিচ্ছবি, এটি সমাজ বদলের এক শক্তিশালী হাতিয়ার। “ভালোবাসার বহিরাবরণ” গ্রন্থের প্রতিটি গল্প যেন আমাদের চারপাশের মানুষদের গল্প—যেখানে আমরা নিজেদের মানুষেরকেও খুঁজে পাই।
এক কথায় বলা যায়, “ভালোবাসার বহিরাবরণ” কেবল ভালোবাসার গল্প নয়, এটি একটি সমাজের বিবেক,সার্থক রুপায়ন।দৈনন্দিন ইতিহাসের প্রতিফলন এবং মানবিক আবেগের দৃষ্টান্ত।
বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের ভান্ডারে “ভালোবাসার বহিরাবরণ” একটি অমূল্য সংযোজন। সুলেখক ও গবেষক আবু সালেহ আহমদের সাহিত্য, আমাদের সমাজ ও মানবজীবনের গভীর উপলব্ধিকে স্পর্শ করে। তিনি সত্যিই বাংলা সাহিত্যের এক অনন্যসাধক, যাঁর চিন্তা, কলম এবং দর্শন সময় পেরিয়ে ভবিষ্যতেও প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবে আমার বিশ্বাস।
সংগ্রহ করার মতো গ্রন্থটির প্রচ্ছদ সাদামাটা হলেও পরিপাটি। প্রচ্ছদ পরিকল্পনা ও অলংকরণ করেছেন রাজবাড়ির মেয়ে দেওয়ান শামিমা রাজা খুকি।
লেখক বইটি উৎসর্গ করছেন। তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী রোকশানা আহমেদ কে। লেখকের ভাযায় “যার উৎসাহ উদ্দীপণা লেখার জগতে প্রেরণা দেয় প্রতিনিয়ত” । সত্যি একান্ত আপনজনে সহযোগিতা ছাড়া কোন কাজে সাফল্য লাভ করা যায়না। নিশ্চয়ই তিনিও ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।
গ্রন্থের অনবদ্য প্রকাশনায় প্রকাশক সুপ্রিয় প্রকাশক বায়েজিদ মাহমুদ ফয়সল লিখেছেন,” গল্পের আঙ্গিক ছোট হলেও দশটি জীবনবোধের গল্প আছে বইটিতে।,,,, নারীপ্রেম ও মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের কথা উঠে এসেছে গল্পগুলোতে,,,,। বিশেষ করে কৈশর এবং যৌবনকে পরম মমতায় আকার চেষ্টা করেছেন তিনি।
,,,,গল্পের কাহিনিবিন্যাশও অমৃতের মতো। এক নিঃশ্বাসে গিলে ফেলা যায়। কোথাও ক্লান্তি আসেনা। বিশ্রামের প্রয়োজন হয়না।
অসাধারণ এই গল্প গ্রন্থটির পাঠক প্রিয়তা কামনা করছি।
আলোচক পরিচিতি: -
নির্বাহী পরিচালক, আলোকিত মানুষ গবেষণা কেন্দ্র হবিগঞ্জ ও সম্পাদক - বানিয়াচং সাহিত্য সংসদ ।
বিষয়: #আলোচনা #আহমদ #এর #গ্রন্থ #ধারাবাহিক #প্রতিচ্ছবি #প্রেম #ভালোবাসা #মানবজীবন #লোকসংস্কআবু #সমাজ #সালেহ
