

রবিবার ● ২৭ এপ্রিল ২০২৫
প্রথম পাতা » বিশেষ » সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে যাচ্ছে বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহের মাটির ছিকরের প্রচলন
সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে যাচ্ছে বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহের মাটির ছিকরের প্রচলন
মতিয়ার চৌধুরী, লন্ডন ::
বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলসহ ময়মনসিংহ বিভাগের কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা এবং সাবেক কুমিল্লার বর্তমান ব্রাম্মনবাড়িয়া জেলায় এক সময় হারিয়ে যাওয়া মাটির ছিকরের ব্যাপক প্রচলন ছিল। পান তামাকের মতো অনেকই ছিকর খেয়ে তাদের নেশা নিবারন করতেন। আর কেউ কেউ এটি ব্যবহার করতের হজমের জন্য। প্রতিটি বাজারে এটি বিক্রি হতো আবার কেউ কেউ বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছিকর বিক্রি করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতেন। এই পেশার সাথে যুক্তছিল কয়েক হাজার পরিবার। কালের বিবর্তনে এই শিল্পটি হারিয়ে যাচ্ছে। এখন আর কাউকে প্রকাশ্যে ছিকর খেতে দেখা যায়না। এখনও অনেকেই ছিকর খেয়ে থাকেন । তবে আগের মতো সকল হাট বাজারে পাওয়া যায়না। যারা এখনও পরিত্যাগ করতে পারনিনি তারা অর্ডার দিয়ে তৈরী করে আনেন। হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ এলাকার গুজাখাইর, দরবেশপুর, ও আগনা এলাকার কয়েক‘শ পরিবার ছিকর তৈরী এবং বিক্রি করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতো। যারা এই পেশার সাথে যুক্ত ছিল এদের স্থানীয় ভাবে বলা হয় ডোকলা। ‘ডোকলা‘ এই ডোকলার আবিধানিক অর্থ হলো শব্দকর। ছিকর তৈরীর পাশাপশি তাদের মূল পেশা ছিল ঢোল বাজানো। এরা পূজা পার্বন বা বিভিন্ন অনুষ্টানে ঢোল বাজিয়ে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতো।
ছিকর একটি ফারসি শব্দ। ছিয়া মানে কালো আর কর মানে মাটি। ছিয়াকর থেকে শব্দটি পরে ছিকর হয়েছে। ছিকর তৈরি হত এক ধরনের পোড়া মাটি দিয়ে। পাহাড়ি টিলায় গর্ত খুঁড়ে লম্বা বাঁশের সাহায্যে গভীর থেকে এক ধরনের মিহি মাটি সংগ্রহ করতো ছিকরের কারিগররা। তারপর তা মাখিয়ে খাই বানিয়ে ছাঁচে ফেলে প্রথমে তৈরি করা হতো মন্ড। তারপর তা পছন্দ মত কেটে টুকরো টুকরো করে ছিকর তৈরী হতো। কারিগরেরা ছিরক তৈরীর মাটি সংগ্রহ করত নবীগঞ্জের দিনারপুরের পাহাড়ি টিলা থেকে।
পরে বিশেষ এক পদ্ধতিতে সেই টুকরো গুলো আগুনে পুড়িয়ে তৈরি করা হতো ছিকর। ছিকর বিভিন্ন আকৃতির করে তৈরি করা হত। কোনোটি দেখতে বিস্কুটের মতো আবার কোনোটি ললিপপের মতো লম্বা ছিল। বিভিন্ন এলাকার ছিকর বিভিন্ন স্বাদের ছিল। কোনো এলাকার ছিকরে খাই মাখানোর সময় গোলাপজল, আদার রস ইত্যাদি মেশিয়ে বিভিন্ন ফ্লেবারে তৈরী করা হতো। । যা মাটির সঙ্গে পোড়ানোর পর ভিন্ন এক স্বাদ পাওয়া যেত। বিশেষ করে গর্ভবতি মহিলাদের পছন্দের শীর্ষে ছিল ছিকর। কোন কোন মহিলা পেটে বাচ্চা আসার শুরেু থেকে ডেলিভারির আগপর্জন্ত নিয়মিত ছিকর খেতেন। ক্রেতা আকৃষ্ট করার জন্য বিক্রেতারা এই ছিকরের ভিন্ন ভিন্ন নাম ব্যবহার করতো। কোনটার নাম ক্যারলিন ছিকর, কোনটা দরবেশপুরি ছিকর, আর কোনটার নাম ছিল অঞ্চল ভেদে যেমন জগন্নাথপুরি ছিকর, সরাইলী ছিকর, অষ্টগ্রামী ছিকর, জগন্নাথপুরি ছিকর, ইন্দেশ্বরী ছিকর ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেক পুরুষও মহিলাদের মতো পান তামাকের বিকল্প হিসেবে ছিকর খেতেন। আমার বেশ মনে আছে একবার দরবেশ পুরের এক শব্দকর ছিরকর নিয়ে এসেছে তাঁকে জিজ্ঞশ করেছিলাম ভাল ছিকর আছেতো উত্তরে জানালেন এটি ক্যারলিন ছিকর । আবার প্রশ্ন করলাম ক্যারলিন ছিকর কেন ছিকর বিক্রেতার সোজা উত্তর ক্যারলিন কাপড় থাকতে পারলে ক্যারলিন ছিকর হতে বাঁধা কোথায়। আমিও উত্তর পেয়ে গেলাম।
বিশিষ্ট লেখক দেওয়ান মাসুদুর রহমান চৌধুরী জানান, মাটিকে ভিজিয়ে নরম করে রুটির মতো ছোট ছোট টুকরার মাধ্যমে বিশেষ প্রক্রিয়ায় শুধু আগুনের ধোঁয়া দিয়ে পুড়িয়ে তৈরি করা হতো ছিকর। গর্ভবতী নারীদের কাছে ছিকর অতি পছন্দের । তাদের অনেকেরই ধারণা ছিল, এটি খেলে রোগ-বালাই থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। যদিও এই ধারণার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বা প্রমাণ আছে কিনা তা জানা যায়নি। এমনও দেখা গেছে শিশু বাচ্চা জন্মের পর নবজাককের গায়ে ছিকরের প্রলেপ পাওয়া যেত । অনেকেই বলতেন এই বাচ্চার মা প্রচুর পরিমানে ছিকর খেয়েছে, একারনে নবজাতকের গায়ে ছিকরের প্রলেপ জমেছে। ছিরক শুধু যে গর্ভবতি মহিলা খেয়ে থাকেন তার অনেকে ওউসদ হিসেবেও ছিকর খেয়ে থাকানে কারো কারো বমি বমি ভাল করলে ছিকর খেলে তা কেটে যায। আবার যাদের সহজে খাবার হজম হয়না তারাও ছির খেয়ে থাকেন।
তবে ছিকর যে একেবারে হারিয়ে যাচ্ছে তা বললে ভূল হবে এখনও নবীগঞ্জ, হবিহঞ্জ, আজমিরিগঞ্জ,বানিয়াচং, চুনারুঘাট, বাহুবল, মাধবপুর, জগন্নাথপুর, মধ্যনগর ,শাল্লা, ধর্মপাশা ,মৌলভীবাজার, রাজনগর, শ্রীমঙ্গল, বালাগঞ্জ সিলেট সদর, জৈন্তাপুর, গেয়াইনঘাট, জকিগঞ্জ , ব্রাম্মনবাড়িয়ার নাসিরনগর ,কিশোরগঞ্জের ইটনা মিঠামইন ও নেত্রকোনা এলাকার গ্রামের বাজর গুলোতে এই ছিকর পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের মানুষ নেশাবা অষুধ হিসেবে মাটির ছিকর খেয়ে থাকলেও আফ্রিকার বেশ কিছূ দেশ আছে এবস দেশের মানুষেরা ক্ষুদা নিবারনের জন্যে মাটি খেয়ে থাকে।
বিষয়: #ছিকর #প্রচলন #বৃহত্তর #মাটি #ময়মনসিংহ #যাচ্ছে #সময় #সাথ #সিলেট #হারিয়ে
