শুক্রবার ● ২১ জুন ২০২৪
প্রথম পাতা » বিশেষ » বিষধর রাসেলস ভাইপার কামড়ালে করণীয়
বিষধর রাসেলস ভাইপার কামড়ালে করণীয়
বজ্রকণ্ঠ নিউজ :
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে বেড়েছে রাসেলস ভাইপারের উপদ্রব। দেশের ২৭টি জেলায় রাসেলস ভাইপারের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বিষধর এ সাপটির দংশনে বিভিন্ন জেলায় মৃত্যুর খবরও পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে খেতের ফসল কাটতে গেলে এ সাপের আক্রমণের শিকার হচ্ছেন চাষিরা। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে ভীষণভাবে। কিন্তু আতঙ্ক দিয়ে তো আর নিষ্কৃতি মেলে না।
ভারতে প্রতি বছর যে পরিমাণ সাপে কাটার ঘটনা ঘটে, তার মধ্যে অন্তত ৪৩ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কায় প্রতি বছর মোট সাপে কাটার ঘটনার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ রাসেলস ভাইপারের কারণে হয়ে থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এখনো এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই।
বাংলাদেশে যেসব সাপ দেখা যায় সেগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে বিষাক্ত বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
সাধারণত কৃষি জমিতে থাকে বলে মানুষ অনেক সময়ই সাপের গায়ে পা দেন বা না জেনে একে বিরক্ত করেন। তখন রাসেলস ভাইপার বিপন্ন বোধ করলে আচমকা আক্রমণ করে বসে। এ জন্য ধানখেত বা গমখেতে কাজে নামার আগে লম্বা বাঁশ দিয়ে জায়গাটি নাড়িয়ে নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, খেতে নামার সময় গামবুট পরে, জিনসের ট্রাউজার পরে কাজে নামতে হবে। এতে সাপের কামড় থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
এ বিষয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপক মোহাম্মদ হাসান তারিক বলেন, রাসেল ভাইপারের দংশনের শিকার ব্যক্তির কিডনি দ্রুত অকেজো হতে শুরু করে। শরীর জ্বালাপোড়া করার পাশাপাশি দংশনের স্থানে পচন ধরে।
একইসঙ্গে দংশনের শিকার ব্যক্তির রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করে। এসব ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসা দেওয় না হলে আক্রান্ত ব্যক্তিকে বাঁচানো সম্ভব হয় না।
সাপটির দংশনের শিকার ব্যক্তিদের চিকিৎসার অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে চিকিৎসক আরও বলেন, রাসেল ভাইপারের এন্টিভেনম থাকলেও সেটা খুব একটা কাজ করে না।
২০১৫ সালের দিকে আমরা প্রথম রাসেল ভাইপারে কামড়ানো রোগী পেয়েছিলাম। সে সময় আক্রান্ত হাত-পা কেটে ফেলেও রোগীকে বাঁচানো যায়নি। তাই সাপটির কবল থেকে বাঁচতে সচেতনতাই কার্যকর পথ।
ভাইপার রাসেলস দংশন করলে করণীয় সম্পর্কে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সুপারনিউমেরারি অধ্যাপক মো. ফরিদ আহসান বলেন, কামড়ে যদি দাঁত বসে যায়, তাহলে ক্ষতস্থানের ওই জায়গাটিসহ ওপর-নিচের খানিকটা জায়গা নিয়ে হালকা করে ব্যান্ডেজ দিয়ে পেঁচিয়ে দিতে হবে। নড়াচড়া করা যাবে না। রোগীকে সাহস দিতে হবে। হাঁটা-চলাচল একেবারেই বন্ধ করে দিতে হবে। যাতে রক্ত চলাচলটা একটু কম হয়। এভাবে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
অধ্যাপক মো. ফরিদ আহসান আরও বলেন, গ্রামাঞ্চলের কোথাও যদি গাড়ি না পাওয়া যায়, তাহলে মোটরসাইকেলে রোগীকে চালক ও আরেক আরোহীর মাঝে বসিয়ে নিতে হবে। তাহলে একটু দ্রুত হবে।
ফরিদ আহসানের জানান, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কামড় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগীকে হাসপাতালে নেওয়া হয় না। অনেকটা দেরি হয়ে যায়। তখন এটা একটা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এই সাপের বিষ এমনই বেশি যে একসঙ্গে শরীরের অনেকগুলো অঙ্গ আক্রান্ত হয়ে যায়।
শুধু রাসেলস ভাইপার নয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে আছে গোখরা, কেউটেসহ নানা জাতের বিষধর সাপ। প্রায়শই মানুষ এসব সাপ দ্বারা আক্রান্ত হয়। সাপ কামড়ালেই মানুষ এক রকম আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। ফলে চিকিৎসা ব্যাহত হয়। ভুক্তভোগীদের একটি বড় অংশই আবার চিকিৎসক বা হাসপাতালের শরণ না নিয়ে ওঝা বা সাপুড়েদের শরণাপন্ন হন। ফলে নিষ্কৃতি তো দূর, সংকট বাড়ে।
এ জন্য জানা প্রয়োজন যে, সাপ কামড়ালে আসলে কী করা উচিত। আর কী করা উচিত নয়। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের আওতায় অসংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের অধীনে একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালা ও গবেষণা হয়। এতে সাপের কামড়ের পর করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে।
সাপে কাটলে যা করবেন
যেকোনো সাপ কামড়ানোর পর ভুক্তভোগীকে রক্ষায় বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। মূলত ভুক্তভোগীকে আশ্বস্ত করা এবং তাকে সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যেই তাৎক্ষণিকভাবে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে-
শুরুতেই ভুক্তভোগীকে আশ্বস্ত করতে হবে যে, সাপের কামড় মানেই মৃত্যু নয়। প্রকৃতিতে থাকা অধিকাংশ সাপেরই বিষ নেই। আর যেগুলো বিষধর বলে পরিচিত, সেগুলোও সব সময় কামড়ের সাথে যথেষ্ট বিষ ঢালতে পারে না। আর বিষ যেমন আছে, তার চিকিৎসায় অ্যান্টিডটও আছে।
কামড়ের স্থান থেকে বিষ যেন শরীরের অন্য অংশে ছড়াতে না পারে তার ব্যবস্থা নিতে হবে।
সাপের কামড়ের পর ভুক্তভোগীকে স্থির করতে হবে। নড়াচড়া করা যাবে না। যত নড়াচড়া করবে শরীরের রক্তের সাথে ওই বিষ তত মিশে যাবে।
পায়ে কামড় দিলে বসে পড়তে হবে।
হাত বা অন্য কোনো অংশে কামড়ালে সে অংশ নড়ানো যাবে না।
সবচেয়ে ভালো হয়, হাড় ভাঙলে যেভাবে দুপাশে সহায়ক হিসেবে কাঠ বা অন্য কিছু দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়, ঠিক সেভাবে আক্রান্ত স্থানকে মাঝে রেখে বেঁধে ফেললে। এ ক্ষেত্রে ক্ষতস্থানটি অবশ্যই পরিষ্কার করে নিতে হবে। ক্ষতস্থানের ওপর তো বটেই সাথে এর আশপাশের অংশও ব্যান্ডেজ করে ফেলতে হবে।
চিকিৎসকের কাছে বা হাসপাতালে পৌঁছানোর আগে এই ব্যান্ডেজ কোনোভাবেই খোলা যাবে না।
হাতে পায়ে চুড়ি, আংটি, নুপূর, বা আঁটসাটো পোশাক থাকলে খুলে নিন।
আক্রান্ত ব্যক্তিকে কাত করে লম্বাভাবে শুইয়ে দিন।
শ্বাস নিতে কষ্ট হলে মুখে কৃত্রিম শ্বাস দেওয়ার চেষ্টা করুন।
সাপ মারা বা তাকে ধরার জন্য অযথা সময় নষ্ট করবেন না।
সাপটিকে যদি মেরে ফেলা হয়, তাহলে আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে নেওয়ার সময় সাপটিও সাথে নিন।
রাসেলস ভাইপারসহ যেকোনো সাপ কামড়ালেই আতঙ্কিত না হয়ে আক্রান্তের চিকিৎসায় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
সাপে কামড়ালে যা করবেন না
ক্ষতস্থান অতিরিক্ত শক্ত করে বাঁধবেন না।
ক্ষতস্থান কেটে বিষ বের করার চেষ্টা করবেন না।
সাপুড়ে বা ওঝাদের ডেকে অযথা সময় নষ্ট করবেন না।
বমি হলে, মুখ দিয়ে ফেনা বের হলে বা কথা বলতে কষ্ট হলে মুখ দিয়ে কিছু দিতে যাবেন না।
কোনো রাসায়নিক ব্যবহার করে বা অন্য কোনোভাবে ক্ষতস্থানের মুখ বন্ধের চেষ্টা করবেন না।
কোনো ধরনের পাথর, লালা, পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, কাদা, গোবর, কোনো ধরনের বীজ বা ভেষজ ওষুধ
প্রয়োগ করতে যাবেন না। সাপের কামড়ের নিদানে এগুলো কিছু করতে পারে না।
অ্যালকোহল বা এ ধরনের কোনো কিছু প্রয়োগ করবেন না।
অ্যাসপিরিন বা কোনো ব্যাথানাশক ওষুধ দেবেন না।
তেল, ঘি, মরিচ ইত্যাদি গৃহস্থালি দ্রব্যাদি অনেক সময় প্রয়োগ করতে দেখা যায়। এগুলো কুসংস্কার মাত্র।
আতঙ্কগ্রস্ত হবেন না। ভুক্তভোগীকে আশ্বস্ত করুন বরং।
চিকিৎসা সেবা নিতে দেরি হয় এমন যেকোনো কাজ থেকে বিরত থাকুন।
সাপে কাটা রোগীদের ক্ষেত্রে ‘রুল অব ১০০’–কে খুবই গুরুত্ব দেন এ সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞরা। এই রুল অব হান্ড্রেড হচ্ছে- সাপে কামড়ানোর ১০০ মিনিটের মধ্যে যথাযথ পরীক্ষার পর চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে ১০০ মিলিমিটার অ্যান্টিভেনম ভুক্তভোগীর শরীরে প্রবেশ করাতে পারলে রোগীর বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ। তাই করণীয়র দিকে মনোযোগ দিন। অহেতুক আতঙ্কিত না হয়ে এবং অতি অবশ্যই ওঝা বা সাপুড়ের মতো ভুল পথে হেঁটে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া এবং নিকটস্থ হাসপাতালে রোগীকে নেয়ার ব্যবস্থা করুন। তাহলেই সাপে কাটা রোগীকে বাঁচানো যাবে।
বিষয়: #করণীয় #বিষধর #ভাইপার #রাসেলস