সোমবার ● ২৪ জুন ২০২৪
প্রথম পাতা » চট্টগ্রাম » কর্ণফুলীতে ভয়ানক প্রতারক চক্র - লন্ডনের অ্যাপস থেকে কিউআর কোড বসিয়ে চেয়ারম্যানের ওয়ারিশ সনদ জাল!
কর্ণফুলীতে ভয়ানক প্রতারক চক্র - লন্ডনের অ্যাপস থেকে কিউআর কোড বসিয়ে চেয়ারম্যানের ওয়ারিশ সনদ জাল!
বজ্রকণ্ঠ নিউজঃ
চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে লন্ডন ভিত্তিক একটি অ্যাপস থেকে কিউআর কোড বসিয়ে নকল ওয়ারিশ সনদ নিয়ে তা উপজেলা ভূমি অফিসের নামজারিতে সরবরাহ করার অভিযোগ উঠেছে পাঁচ সদস্যের প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে।
প্রতারক চক্রটি শিকলবাহা ইউনিয়ন পরিষদের একটি প্রকৃত ওয়ারিশ সনদ সংগ্রহ করে তাতে ওয়ারিশ সংখ্যা বৃদ্ধি করে পুনরায় কিউআর কোড বসিয়ে আনুমানিক ২০-২৫ লাখ টাকার জমির খতিয়ান পেতে তোড়জোড় করছে বলে অভিযোগ উঠে। কিন্তু এসিল্যান্ডের বিচক্ষণতায় তাদের জাল জালিয়াতি ধরা পড়ে।
এদের মধ্যে তিন জন মহিলা আর দুজন পুরুষ। এরা সকলের নামে সম্প্রতি জমিটি ই-নামজারি পেতে কর্ণফুলী উপজেলা ভূমি অফিসে আবেদন করেছেন বলে নিশ্চিত করেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) পিযুষ কুমার চৌধুরী।
ঘটনা সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি শিকলবাহা ইউনিয়নের প্রধান সড়কের পাশের একটা জমি পাঁচ জনের নামে নামজারি করার জন্য আবেদন পড়ে। জমির নামজারি আবেদনের (৫০৫২) সাথে শিকলবাহা ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া ওই চক্রের দেওয়া দুটি ওয়ারিশ সনদে নিজ দফতরের সিল স্বাক্ষরে সত্যায়িত করে উপজেলায় প্রস্তাব পাঠান।
কিন্তু ফাইলটি এসিল্যাণ্ডের সামনে আসলে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। তিনি কিউআর কোডটি স্ক্যান করে দেখেন। এতেই এসিল্যাণ্ডের সামনে জালিয়াতির চিত্র নজরে আসে। কেননা, ইউনিয়ন পরিষদ যে ওয়ারিশ সনদগুলো সরবরাহ করে- সে সব সনদের কিউআর কোড স্ক্যান করলে প্রত্যয়ন লিঙ্ক প্রবেশ করবে এক্সপ্লোর আইটি কারিগরি সহযোগিতায় নির্মিত সনদ-প্রত্যয়ন ব্যবস্থাপনা সিস্টেম প্রত্যয়ন ওয়েবসাইটে।
যেখানে স্পষ্ট ভাবে কর্ণফুলী ডট ওআরজি ওয়েব সাইট লিখা আসবে। প্রতারক চক্রের সরবরাহ করা ওয়ারিশ সনদের কিউআর কোড স্ক্যান করলে লিঙ্ক নিয়ে যায় লন্ডনের মি-কিউআর ডটকমে। আর যে ফটোকপি ওয়ারিশ সনদে কিউআর কোড বসানো হলো, তাতে ওয়ারিশ পাঁচ জন। কিন্তু কোড স্ক্যান করলে যে লিঙ্কে সনদ উপস্থাপিত হয় সেখানে দেখা যায় সাত জন ওয়ারিশ।
এতে দুই সনদে দুই ধরনের তথ্য। আরেক সনদে অর্ধেক কিউআর কোড। সহকারী কমিশনারের চোখে এসব নানা অসংগতি নজরে আসে। পরে তিনি ওয়ারিশ সনদ দুটির বিষয়ে সত্যতা জানতে শিকলবাহা ইউপি চেয়ারম্যান এর কাছে একটি চিঠি প্রেরণ করেন।
যে চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘চলমান নামজারি মামলা নম্বর ৫০৫২/২৩-২৪। এতে আবেদনকারী শিকলবাহা আলম মেম্বার বাড়ির হোছনেয়ারা বেগম, দিদারুল ইসলাম লিটন, নারগিছ আকার মুক্তা, সাতকানিয়া মাইজপাড়ার ফারজানা আক্তার পুতুল, জাহেদুল ইসলাম নামজারির আবেদন করেন।
আবেদনকারীগণ গত ২৭ ফেব্রুয়ারি তারিখের ১০২০৩৯ নম্বর ওয়ারিশ সনদ মূলে ইস্যুকৃত শিকলবাহার মোহাম্মদ মিয়া স্যারাং এর ছেলে নুর মোহাম্মদের একটি ওয়ারিশ সনদ দাখিল করেন। একই তারিখের ১০০৩১৪নং সনদমূলে আরেকটি ওয়ারিশ সনদে শিকলবাহার আবদুল ছৈয়দের ছেলে নুর মোহাম্মদ এর ওয়ারিশ সনদ দাখিল করেন।
কিন্তু কিউআর কোড স্ক্যানিং এর মাধ্যমে যাচাই করতে গেলে ওয়ারিশসনদ সমূহে গরমিল লক্ষ্য করা যায়। সুতরাং দাখিলকৃত ওয়ারিশ সনদ সমূহের সঠিকতা ও সত্যতা যাচাইপূর্বক ৩ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন প্রেরণে ইউপি চেয়ারম্যানকে অনুরোধ জানান কমিশনার।’
চিঠির প্রতিউত্তরে শিকলবাহা ইউনিয়ন পরিষদ জানান, ‘শিকলবাহা এলাকার আলম মেম্বার বাড়ির মোহাম্মদ হারুন ও নুর মোহাম্মদ বিগত ২৭ ফেব্রুয়ারি ইস্যুকৃত স্মারক নং-১০২০৩৯ ও ১০০৩১৪ ওয়ারিশ সনদ দুইটির মধ্যে প্রথমটি সঠিক ও দ্বিতীয়টি সঠিক নয়।’
পরিষদ লিখিত ভাবে আরও জানিয়েছেন, ‘গত ২৭ ফেব্রুয়ারিতে ইস্যুকৃত ১০২০৩৯ স্মারকের ওয়ারিশ সনদটি তার পরিষদ থেকে ইস্যু করা হয়। আর একই তারিখ দেখানো ১০০৩১৪ স্মারকের সনদটি পরিষদ থেকে ইস্যু করা হয়নি। যেটি, ছিল নকল।’
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শিকলবাহা ইউপি সচিব আব্দুল কাইয়ুমও। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, তিনটি সনদের নিচে স্পষ্ট ভাবে লিখা রয়েছে স্থানীয় ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুল্লাহ আল মামুনের তদন্ত ও সুপারিশক্রমে উক্ত ওয়ারিশ সনদ সুপারিশ করা হলো।
এ বিষয়ে তিনটি সনদ দেখে শিকলবাহার ইউপি সদস্য আব্দুল্লাহ আল মামুন বিবার্তাকে বলেন, ‘তিনটি ওয়ারিশ সনদ নকল। তিনি এ ধরনের ওয়ারিশ সনদ কাউকে দেননি। বরং তিনি নুর মোহাম্মদ এর একটি ওয়ারিশ সনদ তার ছেলে সোলায়মানকে প্রদান করেছেন। যার স্মারক নম্বর-১০৫২২১। তাতে স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা মিলে ওয়ারিশ ছিল মোট ৯ জন।’
পরে শিকলবাহা ইউপি সচিব আব্দুল কাইয়ুমের সাথে পুনরায় যোগাযোগ করে জানতে চাওয়া হয় প্রকৃত ওয়ারিশ সনদ অনলাইন সার্ভারে কোনটি রয়েছে। সচিব বিবার্তাকে বলেন, ‘পরিষদ যে সনদটি ইস্যু করেছে তার স্মারক হলো-১০২০৩৯। যেখানে ওয়ারিশ রয়েছে পাঁচ জন।’
পরে ইউপি সচিবকে জানানো হয়। এ ধরনের কোন সনদ ইউপি সদস্য আব্দুল্লাহ আল মামুন কাউকে প্রদান করেনি বলে আমাদের জানিয়েছেন। তার উত্তরে শিকলবাহা ইউপি সচিব আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ‘আমরা মহিলা মেম্বারের স্বাক্ষর নিয়ে ১০২০৩৯ সনদটি দিয়েছি।’ এর জবাবে তাকে আবারো জানানো হয়। তাহলে ওই সনদে মহিলা মেম্বারের স্বাক্ষর নেই কেন? তখন ইউপি সচিব কোন সদুত্তর দিতে পারেনি।
সচিবের মন্তব্যটি পুনরায় ইউপি সদস্য আব্দুল্লাহ আল মামুনকে জানালে তিনি বলেন, ‘মহিলা সদস্যরা এভাবে ওয়ারিশ সনদ দিতে পারে না।’ ওদিকে, বিষয়টি জেনে অবাক হন সহকারী কমিশনার ভূমি। কেননা, সনদ জালিয়াতি ঠেকাতে কর্ণফুলীর পাঁচ ইউনিয়নে কিউআর কোড সম্বলিত সনদ দেওয়ার প্রচলন শুরু করলেও হঠাৎ নকল কিউআর কোড যুক্ত সনদ দেখে আশ্চর্য হন তিনি।
এসব তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে উঠে আসে, শিকলবাহা ইউনিয়ন পরিষদ ১০২০৩৯ নম্বর স্মারকে নুর মোহাম্মদ এর সনদে ওয়ারিশ ছিলেন পাঁচ জন। এক স্ত্রী, তিন পুত্র ও এক কন্যা। কিন্তু নকল কিউআর কোড বসানো একই সনদে একই স্মারক বসিয়ে ওয়ারিশ সৃষ্টি করেছেন সাত জন। এতে নুর মোহাম্মদ এর দুই পুত্র মোহাম্মদ খোরশেদ আলম ও মোহাম্মদ নাছেরকে হারুনের পুত্র হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু এরা দুজন হারুনের পুত্র নয়।
অনুসন্ধানে আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে। প্রতারক চক্রটি প্রকৃত সনদে মিথ্যা দুই ওয়ারিশের নাম বর্ধিত করে ইউনাইটেড কিংডম অব লন্ডনের সেভেন বেল ইয়ার্ড এলাকার মি-টিম লিমিটেড কোম্পানির ‘মি-কিউআর জেনারেটর’ অ্যাপসে প্রবেশ করে নকল সনদে কিউআর কোড যুক্ত করেছেন।
এমন কি প্রতিবেদক লন্ডন ভিত্তিক অ্যাপসটির জনসংযোগ কর্মকর্তা অলেক্সান্ডার এর সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারেন, প্রতিষ্ঠানটি মূলত যোগাযোগের তথ্য, ওয়াইফাই প্রশংসাপত্র, সনদ, মানচিত্র, সামাজিক নেটওয়ার্কগুলির লিঙ্ক শেয়ার করতে কিউআর কোড স্থাপনে কাজ করে।
২০২১ সাল থেকে কোম্পানিটি কিউআর কোড জেনারেটর টুলের মাধ্যমে আদান প্রদান করেন। অ্যাপসটি মাসে ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ ব্যবহার করেন। এই অ্যাপসে প্রবেশ করে মাত্র কয়েক মিনিট বা সেকেন্ডের মধ্যে কোড তৈরি করে দেন কোম্পানিটি।
প্রতিবেদক অনলাইনে কোম্পানিটির সিইও ইভান মেলনিচুককে নকল ওয়ারিশ সনদটি পাঠিয়ে যোগাযোগ করে জানতে চান, কখন কে বা কারা তাদের অ্যাপস থেকে কিউআর কোড বসিয়ে শিকলবাহার কথিত ওয়ারিশ সনদটি তৈরি করেছেন।
জবাবে লন্ডন থেকে ইভান মেলনিচুক বিবার্তাকে জানিয়েছেন, ‘গত এক মাস আগে মেইল অ্যাড্রেস কিংবা মোবাইল নম্বর যুক্ত না করেই সরাসরি ওয়েব সাইট থেকে তাদের কিউআর কোড বসিয়ে সনদটি তৈরি করে নিয়েছিল চক্রটি।’
শিকলবাহা ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন ভূঁইয়ার কাছে সরাসরি জানতে চাওয়া হয়, যে দুটি ওয়ারিশ সনদে তিনি সিল স্বাক্ষর দিয়ে সত্যায়িত করেছিলেন সেটির কিউআর কোড যাচাই-বাছাই করে সত্যতা পেয়েছিলেন কিনা? প্রতি উত্তরে শিকলবাহার তহশিলদার জসিম উদ্দিন ভূইয়া বিবার্তাকে বলেন, ‘এসব ওয়ারিশ সনদ সঠিক ছিল তাই সিল স্বাক্ষর করেছি।’ অথচ সনদ যিনি ইস্যু করেছেন সেই ইউপি চেয়ারম্যান জানালেন সম্পূর্ণ বিপরীত। আর ইউপি সদস্যও বলেছেন ভিন্ন কথা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিকলবাহা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ জাহাঙ্গীর আলম বিবার্তাকে বলেন, ‘উপজেলা ভূমি অফিসকে চিঠি দিয়ে আমরা জানিয়েছি, দুটি ওয়ারিশ সনদ থেকে একটি ছিল আমাদের ইস্যুকৃত আসল সনদ অন্যটি সঠিক নয়।’
এ প্রসঙ্গে কর্ণফুলী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) পিযুষ কুমার চৌধুরী বিবার্তাকে বলেন, ‘সাধারণত ওয়ারিশ সনদ যাচাই লিঙ্ক আসবে প্রত্যয়ন ওয়েব সাইট থেকে। কখনো মি-কিউআর থেকে আসবে না। তা ছাড়া আমি নিশ্চিত ছিলাম এটি নকল সনদ। শিকলবাহা ইউনিয়ন পরিষদও জানিয়েছেন ওটা সঠিক নয়। এমনকি এ ধরনের কোন সনদ তাদের পরিষদ থেকে ইস্যু করা হয়নি। করেছেন একটি। সুতরাং বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
বিষয়: #অ্যাপস #চক্র #প্রতারক #ভয়ানক #লন্ডন