বৃহস্পতিবার ● ১১ জুলাই ২০২৪
প্রথম পাতা » ধর্ম » মু’মিন ও মুনাফিক চেনার সহজ উপায়। হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী।
মু’মিন ও মুনাফিক চেনার সহজ উপায়। হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী।
মু’মিন ও মুনাফিককে বাহ্যিকভাবে চেনা বড়ই কঠিণ। কারণ মুনাফিকরা মু’মিনদের মতই সালাত, সাওম, হজ্জ পালন করে। মু’মিনদের মতই পোষাক-পরিচ্চদ ও বেশভূষা একই। মুনাফিকরা মুসলমানদের মতোই কিতাবের ভালো জ্ঞান রাখে। সুতরাং মুনাফিক এমন এক নিকৃষ্ট কীট বা গোষ্ঠী যাদেরকে চেনা বড়ই দায়। মুনাফিক শব্দটি আরবী নাফকুন শব্দের কর্তৃবাচ্য। যার অর্থ হলো, ইঁদুরের গর্ত। ইদুরের গর্ত বলার কারণ হলো, এ ধরণের গর্তের অনেকগুলো মুখ বা এ´িট থাকে। কোন এক মুখ দিয়ে হামলা এলে ইঁদুরগুলো অন্য কোন পথ দিয়ে যাতে বেরিয়ে যেতে পারে, সেই জন্য এ ধননের অসংখ্য এ´িট পথ তৈরী করে রাখে। সমাজের মুনাফিকগুলোর অবস্থাও ঠিক তদ্রুপ। তারা দেখতে শুনতে লেবাসে হুবহু মুসলমানদের মতোই মনে হলেও সত্যিকার অর্থে তারা মু’মিন-মুসলমান নয়। তারা মুসলিম জামা’আতের কখনো হিতাকাঙী নয়। তারা বরং কুফফার ও মুশরিকদেরই হিতাকাঙী। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন,“তুমি কি তাদেরকে দেখোনি, যাদেরকে কিতাবের জ্ঞান থেকে কিছু অংশ দেয়া হয়েছে এবং তাদেরকে অবস্থা হচ্ছে এই যে, তারা জিবত ও তাগুতকে মানে আর কাফেরদের সম্পর্কে বলে ঈমানদারদের তুলনায় এরাই তো অধিকতর নির্ভুল পথে চলেছে।”(সুরা নিসা:৫১)
রাসুলুল্লাহ সা: এর যুগে এরা নিয়মিত রাসুল সা: এর ইমামতিতে তাঁর পেছনে সালাত আদায় করতো। ফলে তাদেরকে ইসলামের শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করা অনেক কঠিন ছিল। কিন্তু আল্লাহর রাসুল সা: ও তাঁর সাহাবাগণ তাদেরকে জানতেন এবং চিনতেন। কিন্তু তাদের দৈনন্দিন কাজের জন্য তাদেরকে আলাদা করা কঠিণ ছিল। এ জন্য তাদেরকে ইসলামের জন্য খুব বিপদজনক মনে করা হতো। কারণ ঘরের শত্রু বিভিষণ মারাত্মকই হয়ে থাকে।
মু’মিন মুনাফিক চেনার সহজ উপায় হলো, জিহাদ। রাসুলুল্লাহ সা: এর যুগে জিহাদের ডাক এলে চেনা যেতো কারা মু’মিন ও কারা মুনাফিক। বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে জিহাদ থেকে বিরত থাকতো। জিহাদের ডাক এলে মু’মিন ও মুনাফিকদের পক্ষ থেকে কি ধরণের জবাব আসতো তা আল কুরআনের আলোকে পেশ করা হলো।
সাচ্চা ঈমানদার: যারা সাচ্চা ঈমানদার তাদের সামনে জিহাদের ডাক এলে, তা যতই কঠিন হোক এতে তাদের ঈমান আরো বেড়ে যেতো। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “ঈমানদার তো তারাই আল্লাহকে স্মরণ করা হলে যাদের হৃদয় কেঁপে উঠে। আর আল্লাহর আয়াত যখন তাদের সামনে পড়া হয়, তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং তারা নিজেদের রবের ওপর ভরসা করে। তারা সালাত কায়েম করে এবং যা কিছু আমি তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে খরচ করে। এ ধরণের লোকেরাই প্রকৃত মু’মিন। তাদের জন্য তাদের রবের কাছে রয়েছে বিরাট মর্যাদা, ভুলত্রুটির ক্ষমা ও উত্তম রিযিক।”(সুরা আনফাল:২-৪) আল্লাহর স্মরণে তাদের অন্তরাত্মা ভয়ে কেঁপে উঠে। যারা সাচ্চা ঈমানদার তারা অন্তরে সর্বদা আল্লাহর ভয় রেখে পথ চলে। যখনই আল্লাহর কথা স্বরণ হয়, তখনই তাদের অন্তর কেঁপে উঠে। তারা বিশ্বাস করে আল্লাহ সামিউল বাছির, আল্লামুল গুয়ুব, রাকিব, তাই কোন গোনাহের কাজে লিপ্ত হতে চাইলে তাদের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে এই ভয়ে যে, আল্লাহ আমাকে দেখছেন। ফলে সে সর্বপ্রকার গুনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকে। আল্লাহর ভয় তাকে সর্বদা তাড়া করে ফিরে। যে কোন কাজ করার সময় তা আল্লাহর হুকুম মতো হচ্ছে কিনা সে তা চিন্তা করে। তারা সেটিকেই সঠিক মনে করে, যাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হয়। তাদের সামনে আল্লাহর আয়াত তেলাওয়াত করা হলে, তাদের ঈমান বেড়ে যায়। অর্থাৎ যখনই তাদের সামনে আল্লাহর কোন হুকুম আসে এবং তারা তার সত্যতা মেনে নিয়ে আনুগত্যের শির নত করে দেয়, আর তখনই তাদের ঈমান বেড়ে যায়। এ ধরনের প্রত্যেকটি অবস্থায় এমনটিই হয়ে থাকে। যুদ্ধের ডাক এলে তা যতই কঠিন হোক, জীবন হুমকীর সম্মুখীন হোক, কোন পরোয়া নেই কারণ এমন এক সত্ত্বার কাছ থেকে সেই হুকুম এসেছে যিনি সর্বজ্ঞাত, যিনি নিগাহবান, সকলেই তাঁর সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে আছে। তাই তারা যখনই আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসুলের হিদায়াতের মধ্যে তারা এমন কোন জিনিস দেখে যা তার ইচ্ছা আশা-আকাংখা, চিন্তা-ভাবনা মতবাদ, পরিচিত আচার-আচরণ, স্বার্থ-আরাম-আয়েশ, ভালবাসা ও বন্ধুত্ব বিরোধী হলেও সে তা মেনে নেয় এবং এইগুলোর বিপরীতে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিধান পরিবর্তন না করে বরং নিজের উল্লেখিত আদত-অভ্যাসগুলো নির্দি¦ধায় পরিবর্তন করে ফেলে। আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিধান গ্রহণ করতে গিয়ে কষ্ট স্বীকার করার ফলে তাদের ঈমান তরতাজা ও পরিপুষ্টতা লাভ করে।
সাচ্চা মুনাফিক: পক্ষান্তরে মুনাফিকদের অবস্থা হয় তার সম্পুর্ণ বিপরীত। তারা যুদ্ধের ডাক শুনলে মুত্যুকে সাক্ষাত সম্মুখে হাজির মনে করে। ফলে তারা জমিকে আকঁড়ে ধরে যুদ্ধে যেতে বিভিন্ন বাহানা পেশ করতে থাকে। দু হাতের বাহিরে তারা আরো অসংখ্য অজুহাত প্রদর্শন করতে থাকে। রাসুলুল্লাহ সা: এর যুগে মুনাফিকদের এ ধরণের বহু উদাহরণ রয়েছে। উহুদ, তাবুকসহ আরো অনেক যুদ্ধ থেকে তাদের পৃষ্ট প্রদর্শনের ইতিহাস রয়েছে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন,“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করো এবং হুকুম শোনার পর তা অমান্য করো না। তাদের মতো হয়ে যেয়ো না, যারা বললো, আমরা শুনেছি অথচ তারা শোনে না।”(সুরা আনফাল:২০-২১) এখানে শোনা বলতে এমন শোনা বুঝায় যা মেনে নেয়া ও গ্রহণ করা অর্থ প্রকাশ করে। যেসব মুনাফিক ঈমানের কথা মুখে বলতো কিন্তু আল্লাহর হুকুম মেনে চলতো না এবং তার আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতো তাদের দিকেই এখানে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ জন্য পরের দু আয়াতে বলা হয়েছে যে, “অবশ্যি আল্লাহর কাছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ধরণের জানোয়ার হচ্ছে সেই সব বধির ও বোবা লোক যারা বিবেক-বুদ্ধি কাজে লাগায় না। যদি আল্লাহ জানতেন এদের মধ্যে সামান্য পরিমাণও কল্যাণ আছে তাহলে নিশ্চয়ই তিনি তাদেরকে শুনতে উদ্ধুদ্ধ করতেন। যদি তিনি তাদের শুনাতেন তাহলে তারা নির্লিপ্ততার সাথে মুখ ফিরিয়ে নিতো।”(সুরা আনফাল:২২-২৩)
মুনাফিকরা সত্য কথা শোনেও না, সত্য কথা বলেও না। তাদের কান ও মুখ সত্যের ব্যাপারে বধির ও বোবা। যুগে যুগে কালে কালে এ ধরণের মুনাফিক আমাদের সমাজ ও সভ্যতায় বিদ্যমান ছিল, আজো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। আজো লেবাসধারী মু’মিন ও মুসলমান রয়েছে যারা প্রকৃতপক্ষে মুনাফিক। যারা মুসলমানদের জিহাদ দেখলে হয় তারা বোবা ও বধির সাজে অথবা সত্য কথা শোনে না বা বলে না। অথবা কথা বললে সত্যকে আড়াল করে এবং সত্য কথাকে তারা বৈষয়িক স্বার্থে অন্যের কাছে বিক্রয় করে দেয়। এমনকি নিলর্জ্জভাবে পৃথিবীর সম্প্রসারণবাদী ইহুদী-খৃষ্টানদের চর-দালাল-এজেন্ট হিসাবে কথা বলে। সামান্য বৈষয়িক স্বার্থে এরা নিজেদের ঈমান-আমল বিদেশীদের কাছে বন্ধক রাখে। এরা সব সময় জালেম ও তাগুতী শক্তির সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করে।
আল্লাহ তা’আলা বলেন,“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ডাকে সাড়া দাও, যখন রাসুল তোমাদের এমন জিনিসের দিকে ডাকেন যা জীবন দান করবে আর জেনে রাখো আল্লাহ মানুষ ও তার দিলের মাঝখানে আড়াল হয়ে আছেন এবং তোমাদের তাঁর দিকেই সমবেত করা হবে।”(সুরা আনফাল:২৪) মানুষের মুনাফেকী আচরণ থেকে বাঁচবার জন্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী পদ্ধতি যেটি হতে পারে, তাহলো তার মনে দুটো বিষয় বদ্ধমূল করে দেয়া। এক, যাবতীয় কর্মকা- সেই আল্লাহর সাথে জড়িত যিনি মনের অবস্থাও জানেন। মানুষ তার মনে মনে যে সংকল্প পোষণ করে এবং মনের মধ্যে যেসব ইচ্ছা, আশা, আকাংখা, উদ্দেশ্য, লক্ষ ও চিন্তা-ভাবনা লুকিয়ে রাখে তার যাবতীয় গোপন তথ্য তাঁর কাছে দিনের আলোর মতই সুস্পষ্ট। দুই, একদিন আল্লাহর সামনে যেতেই হবে। তাঁর হাত থেকে বের হয়ে কেউ কোথাও পালিয়ে বাঁচতে পারবে না। এ দুটি বিশ^াস যত বেশী শক্তিশালী ও পাকাপোক্ত হবে ততই মানুষ মুনাফেকী আচরণ থেকে দুরে থাকবে। এ জন্য মুনাফেকী আচরণের বিরুদ্ধে উপদেশ দান প্রসংগে কুরআন এ বিশ^াস দুটির উল্লেখ করেছে বার বার।
আল্লাহ তা’আলা বলেন,“যে ব্যক্তি এ অবস্থায় পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে সে আল্লাহর গযবে ঘেরাও হয়ে যাবে। তার আবাস হবে জাহান্নাম এবং ফিরে যাবার জন্যে তা বড়ই খারাপ জায়গা।”(সুরা আনফাল:১৬) নিছক কাপুরুষতা ও পরাজিত মানসিকতার কারণে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে ছত্রভংগ হয়ে পালানো হারাম। কারণ এ ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য ও লক্ষের তুলনায় মানুষের প্রাণটাই তার কাছে বেশী প্রিয় হয়ে উঠে। এর পালানোকে কবীরা গুনাহের মধ্যে গণ্য করা হয়েছে। তাই রাসুলুল্লাহ সা: বলেন তিনটি গুনাহ এমন যে, তার সাথে কোন নেকী সংযুক্ত হলেও কোন লাভ নেই। এক, শিরক। দুই, বাপ-মায়ের অধিকার নষ্ট করা। তিন, আল্লাহর পথে লড়াই এ ময়দান থেকে পালানো। এভাবে তিনি আর একটি হাদীসে এমন সাতটি বড় বড় গুনাহের কথা বর্ণনা করেছেন যা মানুষের জন্যে ধ্বংসকর এবং পরকালেও তাকে ভয়াবহ পরিণামের মুখোমুখি করবে।
লেখক: বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ লেখক ও কলামিস্ট হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী, সাবেক ইমাম ও খতিব কদমতলী মাজার জামে মসজিদ সিলেট।
বিষয়: #দুধরচকী #মুনাফিক #মু’মিন