মঙ্গলবার ● ১৬ জুলাই ২০২৪
প্রথম পাতা » বিশেষ » সোয়ানসী শহরে অনুষ্ঠিত হলো বৃহত্তম ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান
সোয়ানসী শহরে অনুষ্ঠিত হলো বৃহত্তম ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান
দেওয়ান ফয়সাল:
গত ৯ই জুলাই সোয়ানসী শহরের সাউথ ওয়েলসের বৃহত্তম মসজিদ ”সোয়ানসী মস্ক” এর হল রুমে বর্ণাঢ্য আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলে ওয়েলসের মধ্যে প্রথমবারের মতো বৃহত্তম এক ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে সোয়ানসী, পোর্ট টালবট, নীথ, ব্রিজেন্ড সহ আশেপাশের এলাকাগুলো থেকে ব্যবসায়ী, কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ, কাউন্সিলার, সাংবাদিক সহ প্রায় চারশত আমন্ত্রিত অতিথি অংশ গস্খহণ করেন।
অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন সোয়ানসী শহরে স্থায়ীভাবে বসবাসরত বিশিষ্ট ব্যবসায়ীদের মধ্যে ঘনিষ্ট কয়েকজন বন্ধু মিলে। বলা যায়, বন্ধু মহলের উদ্যোগে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন। যার ফলে দলমত নির্বিশেষে কমিউনিটির সর্বস্তরের মানুষ উৎসাহী হয়ে এই ঈদ পুনর্মিলনীতে অংশ গ্রহণ করেন। ্আমন্ত্রিত অতিথিদের স্বাগতম জানান আয়োজকরা।
রাত সাড়ে ১১টায় এশার নামাজের পরপরই আমন্ত্রিত অতিথিরা হলে এসে পৌছে গেলেই শুরু টেবিলে খাবার দেয়া। বিভিন্ন ধরণের স্টার্টার এবং মুখরোচক, বিভিন্ন ধরণের খাবারে ভর্তি ছিলো টেবিলগুলো। ওয়েটাররা টেবিলে টেবিলে খাবার পরিবেশন করেন। খাবার শেষে মিষ্টি দই এর সাথে গোলাবজাম পরিবেশন করা হয়। পেটপুরে খাওয়া দাওয়া শেষে শুরু হয় গল্পের আসর। ভোর রাত ২টায় শেষ হয় অনুষ্ঠান।
হল ভর্তি মানুষের উপস্থিতিতে হল রূম হয়ে ওঠে বন্ধু মহলের মধ্যে গল্পের আসরে। প্রত্যেকেই নিজেদের বন্ধু-বান্ধব নিয়ে বসে পড়েন টেবিলে। অনেককে দেখা গেছে ৪০/৫০ বছর আগে রেষ্টুরেন্টে এক সাথে কাজ করেছেন, এমন বন্ধুদের সাথে দেখা হয়ে খুশিতে আত্মহারা। সেই যৌবনকালের বন্ধুরা ছিলেন সুঠাম দেহের অধিকারী, আনন্দ ফুর্তিতে মাতিয়ে রাখতেন আসর, আজ তারা বৃদ্ধ বয়সে এক সাথে বসে বসার সুযোগ পেয়ে অতীতের সেই গল্পগুলো রোমন্থন করে আসর জমিয়ে তুলেছেন, সেই যৌবনকালের মতোই। বিভিন্ন টেবিলের পাশ দিয়ে হাটছি আর শুনছি তাদের গল্প। বিভিন্ন টেবিলে বিভিন্ন ধরণের গল্প- রাজনৈতিক আলাপ সহ নানান বিষয়ের উপর চলছে আলাপ-আন্চোনা, পর্য্যালোচনা। সবগুলো টেবিল চক্কর দিয়ে যখন ফিরে আসছি তখন নূর ভাই যাদের রেষ্টুরেন্টে আমি কাজ করছি, তিনিও অশোকা রেষ্টুরেন্টের একজন পার্টনার, আমাকে ডাক দিলেন। এ সময় আমার সহকর্মী ম্ঈানুল হাসানকে অনুষ্ঠানের ছবি এবং ভিডিও করার দায়িত্ব দিয়ে তাদের টেবিলের সামনে চলে আসলাম।
৩০টি রুটি খাওয়ার গল্প :
নুর ভাই পরিচয় করিয়ে দিলেন উনার এক বন্ধুর সাথে, নাম তার ’রাজ’। রাজ ভাই সুঠাম দেহের অধিকারী, লম্বা প্রায় ৬ ফুট। এই বুড়ো বয়সেও তাকে এমন বুড়ো দেখায় না। খুবই হাসিখুশির মানুষ। তখন টেবিলের চারদিকে সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন আর হাসছেন। নূর ভাই আমাকে বললেন, রাজ ভাইকে লক্ষ্য করে, এই যে লোকটাকে দেখছেন, সে আমার প্রায় ৫০ বছর আগের বন্ধু, শুধু সে-ই নয়, আমাদের এখানে সবাই অনেক অনেক পুরনো বন্ধু , আমরা এক সাথে কাজ করেছি অনেক বছর। আমাকে বললেন আজ ধেকে ৪০ বছর আগে, একদিন আমরা রেষ্টুরেন্টে নেমে কাজ শুরু করেছি, এমন সময় আমাদেরই আরেক বন্ধুর সাথে কে কত খেতে পারে তা নিয়ে বাকযুদ্ধ চলছিলো রাজের। এমন সময়, একজন রাজের সাথে রুটি খাওয়ার ’বাজি’ ধরলো। ঐ বন্ধুটি রাজকে বললো যদি ৩০টা রুটি খেতে পারিস, তাহলে আমি তোকে ২ শত পাউন্ড দেবো, আর যদি না খেতে পারিস তাহলে আমাকে দিতে হবে। তবে শর্ত হলো, শুধুমাত্র শুকনো রুটি খেতে হবে, সাথে কিছু মেশাতে পারবে না এমন কি পানিও না। সবাই অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। রাজ ভাই নাকি রাজি হয়ে গেলেন বললেন, আমি রাজি। সবাই তখন অবাক হয়ে রাজ ভাইকে জিজ্ঞাসা করলেন, তা কি ভাবে সম্ভব রাজ? পারবি খেতে। রাজ ভাই নাকি বললেন, আরে ধোর, আমি খাবো। শুরু হয়ে গেল রুটি বানানোর পালা। ৩০টি রুটির গোল্লা বানিয়ে রাখা হলো সবার সামনে। খাওয়া শুরু করার জন্য রাজ ভাই প্রস্তুত। একটা একটা করে ফানের মধ্যে রুটি ভেজে তার সামনে দেয়া হচ্ছে গরম গরম, আর তিনি খেতে শুরু করেছেন। খেতে খেতে নাকি ৩০টা রুটিই তিনি শেষ করে ফেললেন, মাঝে মাধ্যে একটু হাঁটা-হাঁটি করলেন, এই-যা। বেশ কিছুক্ষণ পর সামান্য একটু পানি পান করলেন। এরপর দেখা গেলো পেটটা বেশ বড় হয়ে উঠছে। বন্ধুরা সবাই জিজ্ঞেসা করলেন, কি-রে রাজ, ঠিক আছিস নাকি? তিনি সগর্বে বললেন, হ্যাঁ আমি পুরোদমে ঠিক আছি। সবাই অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। শেষ পর্য্যন্ত রাজ ভাইর নাকি কোন অসুবিধা হয়নি। রাজ ভাইকে সামনে রেখে নূর ভাই যখন আমাকে গল্পটি বলছিলেন, সবাই তখন হাসতে হাসতে বেহুঁশ। আমি রাজ ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম ভাই তা কি সত্যি? আরও দু’জনকে দেখিয়ে বললেন, হ্যাঁ ওরাও তখন ছিল। জিজ্ঞাসা করলাম খাওয়ার পর কোন অসুবিধা হয়নি? বললেন এমন কোন অসুবিধা হয়নি। এমন সাহসিকতার পরিচয় দেওয়াতে উনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবার ধীরে ধীরে হাটতে শুরু করলাম অন্য টেবিলের দিকে।
দেখলাম, অন্য একটি টেবিলে কয়েকজন বন্ধু আলাপ করছেন ফিলিস্তিন-গাজা নিয়ে। কথা বলতে বলতে এক সময়ে বেশ উচ্চস্বরেই শুরু হলো কথাবার্তা। তাদের পাশের অন্য টেবিলের কাছে দাড়িয়ে শুনছিলাম তাদের কথাবার্তা। যারা ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলছিলেন, আমার যেন মনে হয়েছিলো আর কয়েক মাসের মধ্যেই ফিলিস্তিন স্বাধীন হয়ে যাবে। তারা বলছেন, হুতিরা ইসরায়েলের উপর রকেট ছুড়ে যে ভাবে ইসরায়েলকে নাস্তানাবুদ করে তুলছে, তাতে ইসরায়েল ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে! সারা বিশ্বের কয়েকটি দেশের সাধারণ জনগণও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বন্ধের জন্য সোচ্চার হয়ে ওঠেছে সুতরাং ইসরায়েলকে হার মানতেই হবে। মনে মনে ভাবলাম, এই ক’মাস আগে থেকে হুতিরা যখন রকেট হামলা শুরু করেছে এবং তার জবাবে ইসরায়েলী সৈন্যরা যখন ফিলিস্তিনের হাজার সাধারন মানুষকে নির্বিচারে হত্যা শুরু করে, আজকে এই ফিলিস্তিনবাসীদের জন্য সবাই কান্নাকাটি করছে। কিন্তু ফিলিস্তিনের মানুষ আজ থেকে হাজার হাজার বছর ধরে ইসরায়েলিদের হাতে যে ভাবে প্রাণ দিচ্ছে, তার খবর কি তারা জানেন? জানেন কি ফিলিস্তিনীদের উপর নির্য্যাতনের ইতিহাস? সারা বিশ্বের জনগণ যখন জেগে ওঠেছে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে, তখন মুসলিম দেশগুলো সেই আমেরিকা, ব্রিটেনের তাবেদার হয়ে বসে আছে। ইসরায়েলের শক্তি তো সেই আমেরিকা আর ব্রিটেনের মতো বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোই। এছাড়াও বিশ্বের অ-মুসলিম দেশগুলোও তাদের পক্ষে। সহজ কথায় বলা যায়, যতদিন পর্য্যন্ত মুসলিম বিশ্ব এই শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে এক হয়ে না দাঁড়াচ্ছে, ুততদিন পর্য্যন্ত ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আদায় করা সম্ভব নয়।
নানা- নাতির গল্প
অন্য একটি টেবিলের পাশে যখন গেলাম, শুনলাম এক ভদ্রলোক ্একটি একটি গল্প বলছেন। একদিন এক ছেলে তার নানার সাথে মসজিদে গেছে। মসজিদের মিয়াসাব অর্থাৎ মৌলানা সাহেব ওয়াজ করছেন। বলছেন- মুসল্লি ভায়েরা আমার, আপনারা মন দিয়ে আমার কথাগুলো শুনুন, অনেক পাপ থেকে বেঁচে থাকতে পারবেন। আপনারা যখন রাস্তা দিয়ে হাটবেন, তখন এদিক সেদিক কম তাকাবেন। মাথা নীচু করে হাঁটবেন। কোন মেয়েলোক যদি দেখেন, তাহলে মুখ অনেদিকে ঘুরিয়ে নেবেন, কারণ আমাদের সাথে শয়তান সব সময় থাকে। কোন মেয়েলোক দেখলে আপনাকে কু-মন্ত্রণা দিতে পারে। যদি মুখ ফিরিয়ে নেন, তাহলে এই গোনাহ থেকে বেঁচে গেলেন। শয়তানের কু-মন্ত্রণা থেকে বেঁচে গেলেন। হাটতে হাটতে সব সময় আল্লাহর জিকির পড়বেন। ঘরে স্ত্রীর সাথে ভাল ব্যবহার করবেন, দেখবেন আপনার সংসার সুখী হবে। স্ত্রী যদি কোন কারনে অভিমান করে, তাকে হাতিয়ে- মাতিয়ে খুশী করার চেষ্টা করবেন। কারণ শয়তার সব সময়ই চেষ্টা করে সুখী একটা সংসারে ঝগড়া লাগিয়ে সংসার ভেঙ্গে দিতে।
আরেকটা কথা সব সময় মনে রাখবেন, আমরা মুসলমান। আমাদের পরিধানের কাপড়-চোপর সব সময় পরিস্কার রাখবেন, তাহলে সময় মতো নিশ্চিন্তে নামাজ পড়তে পারবেন। আরেকটা কথা মনে রাখবেন হাটুর উপর কথনও লুঙ্গি তুলবেন না, তা হবে সুন্নতের বরখেলাপ। গোনাহ হবে।
মসজিদে নামাজ শেষ হওয়ার পর সবাই চলে যাচ্ছে। নানা নাতিও বাড়ির দিকে রওয়ানা দিয়েছেন। তাদের বাড়ি যেতে হলে একটা খাল পাড়ি দিতে হয়। খালের মধ্যে কোমর সমান পানি। নানা নাতি পানির মধ্য দিয়ে খাল পাড়ি দিচ্ছেন। নাতি সামনে দিয়ে হাটছে। নাতি খালের মধ্যে নেমে পানির মধ্য দিয়ে লুঙ্গি ভিজিয়ে খাল পার হয়ে ওপারে গিয়ে উঠলো। পেছন ফেরে তাকিয়ে দেখে নানা খাল পাড়ি দিচ্ছে কিন্তু লুঙ্গি ভিজতেছে না, কারণ পানি শরীরের যত ওপরে ওঠে নানা লুঙ্গি ততই উপরে তুলেন। হাটতে হাটতে পানি যত নীচে নামছে নানার লুঙ্গিটাও ততই নীচের দিকে নামছে। নানা যখন খাল পাড়ি দিয়ে এপাড়ে চলে আসলেন, তখন নানার লুঙ্গিটি একেবারে শুকনো। নাতি তার নানাকে বললো, নানা মিয়াসাব না ওয়াজে বললেন, হাঁঠুর উপর কাপড় তোনা নিষেধ! তোমার ওয়াজের কথা মনে নেই? নানা হেসে বললো, হায়রে নাতি, সব কথা যদি মাথার মধ্যে জমা রাখি, তাহলে তোর নানির আদেশ নির্দেশ মনে রাখার জায়গা থাকবে কোথায়?
বড় বড় অনুষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন ধরণের আলাপ-আলোচনা হয়েই থাকে এবং এগুলোই আনন্দের খোড়াক। ওয়েলসে আসার পর থেকে বিভিন্ন ধরণের অনুষ্ঠানে গিয়েছি, তবে সোয়ানসীর এবারের ঈদ পুণর্মিলনী অনুষ্ঠানের মতো বন্ধু মহলের আড্ডা এবং মন খোলে আনন্দ ফূর্তির কথাবার্তা বলার মতো পরিবেশ আমি আর কোথাও দেখিনি। যার কারণে অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদের ভীষণ খুশি হতে দেখেছি। এমন কি বিদায় নেয়ার সময় সবাই আয়োজকদের সাথে হাত মিলিয়ে আগামীতেও যেন এ ধরণের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় সে জন্য অনুরোধ জানান এবং সেই সঙ্গে তাদের পূর্ণ সহযোগিতারও আশ্বাস প্রদান করেন। এ ধরণের একটি সুন্দর সময় উপহার দেয়ার জন্য তাদের সবার প্রতি আন্তরিক ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন আগত অতিথিরা।
এই ঈদ পুণর্মিলনী অনুষ্ঠান সফল করে তুলতে উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে যারা কয়েকটা সপ্তাহ ভীষণ পরিশ্রম করেছেন তারা হচ্ছেন সর্বজনাব আব্দুল লতিফ (কয়ছর), মনফর আলী, আব্দুল কাদির, আনছার মিয়া, আহমেদ আলী, শামিম আহমেদ, আবুল কালাম, ফারুক মিয়া, হাবিবুর রহমান, ফারুক মিয়া, খন্দকার আব্দুল ওয়াহিদ, মঈন উদ্দিন, ইমন ফারুকী, মঈন উদ্দিন , আব্দুল কাইউম, আফসর আলী, লুকমান হোসেন, খালেদ শিকদার, আব্দুল নূর, সুহেল আহমেদ, খালিক মিয়া, মোহাম্মদ লিটন, আকবর মিয়া, ফুয়াদ চৌধুরী, খালেদ মিয়া, আনোয়ার আলী, মোহাম্মদ রফিক, নজমুল হুদা, মনজু মিয়া, শামসুদ্দিন ও শহিদুর রহমান প্রমুখ।
বিষয়: #অনুষ্ঠিত #শহর #সোয়ানসী