শুক্রবার ● ৭ জুন ২০২৪
প্রথম পাতা » বিশেষ » ব্যাংক থেকে টাকা লুটপাট বন্ধ করুন
ব্যাংক থেকে টাকা লুটপাট বন্ধ করুন
দেওয়ান ফয়সল :
বাাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাঙ্ক থেকে টাকা লুটের যে হিড়িক পড়েছে, তা দেখে দেশবাসী হতবাক হয়ে পড়েছে। মানুষের মনে প্রশ্ন জেগেছে, কি ভাবে এত টাকা লুট হয় তা কি কর্তপক্ষ জানেন না বা জানলেও কেন এর প্রতিকারের কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না?
আসলে আমাদের দেশে ব্যাঙ্ক লুটের ধরনটা হচ্ছে ভিন্ন স্টাইলে। আজকাল দেশে কোটিপতির সংখ্যা হাতে গুণে শেষ করা যাবেনা। প্রশ্ন হচ্ছে, ওরা কিভাবে কোটিপতি হচ্ছে? হ্যাঁ ওরা ব্যবসা করেই কোটিপতি হচ্ছে। এদের আছে নামে-বেনামে বিভিন্ন ধরণের ব্যবসা প্রতিণ্ঠান। ব্যবসা করতে গেলেইতো টাকার দরকার। তখন তারা করে কি, নিজের কাছ থেকে কিছু টাকা ব্যাঙ্কে রেখে বাকি টাকার জন্য লোনের দরখান্ত করে। এই দরখাস্ত দাখিল করার আগেই তারা লোন অনুমোদন যারা করেন উচ্চ পর্য্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করে বড় অংকের টাকা তাদের পকেটে ঢেলে দেয়। এরপর ব্যাংকে যখন লোনের জন্য দরখাস্ত দাখিল করে, তার আগেই উপরের মহল থেকে ব্যাংকে নির্দেশ এসে যায়, অমুকের এত কোটি টাকার লোন নেয়ার অনুমতি দিয়ে দেন। এছাড়াও ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের সাথেও একটা লেনদেন অগোচরে হয়ে যায়। সুতরাাং টাকা নিতে আর অসুবিধা কোথায়? এ ধরণের কর্মকান্ডের ইতিহাস এখন দেশের মানুষ জেনে গেছে। যাদের ক’দিন আগে দেখেছে টাকার জন্য মানুষের কাছে হাত পাততে, আজ তারা কোটিপতি!
এসব কোটিপতিদের ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো করে ঘাটলে দেখা যায়, তারা খুবই নিম্ন বিত্ত পরিবার থেকে এসেছে। মা-বাবা অনেক কষ্ট করে টাকা উপার্জন করে পড়ালেখা করিয়েছে যাতে তাদের সন্তান একজন মানুষের মতো মানুষ হয়। কিন্তু দেখা যায়, তারা পড়ালেখা করে উচ্চ ডিগ্রি নেয় যাতে লক্ষ-কোটি টাকা রোজগার করতে পারে সেই উদ্ধেশ্য নিয়ে। একটা বড় ডিগ্রি নিয়ে দেশকে উচ্চতর মর্য্যাদায় পৌছানোর চেষ্টা করা, তা তারা মোটেই চিন্তা করেনাা তার অবশ্য একটা কারন সবারই চোখে পড়ে, তাদের মা- বাবা কি ধরণের কাজ করে কি ভাবে টাকা রোজগার করেছে, স্বচক্ষে তারা দেখছে। টাকার সেই অভাব মেটানোর লক্ষ্যেই তারা দেশের চেয়ে বরং নিজেকে অর্থাৎ পরিবারকে সমাজের উচ্চ পর্য্যায়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিদ্বন্ধিতায় মেতে ওঠে। এ ধরণের লোকরাই কোটিপতির কাতারে। তবে যারা সত্যিকার অর্থে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা নিয়ে সঠিক ভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের সংখ্যা শতকরা ১০ ভাগের মতো হবে বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা।
ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, টেকনিশিয়ান ইত্যাদিতে পড়ালেখা করে এসব ছাত্রছাত্রীরা মানুষের কথা তথা দেশের উন্নয়নে কাজ করতে তারা মোটেই আগ্রহী নয়। বর্তমানে দেশের যে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে, তা বিদেশের সাথে চুক্তি করে করতে হচ্ছে, তারা সব কাজ করে দিচ্ছে।বিদেশীরা কাজ করে দেশের কোটি কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর আমাদের দেশের ইউনিভার্সিটিগুলো থেকে শত শত ছাত্র ছাত্রী পাশ করে বের হচ্ছে, কিন্তু দেশবাসী তাদের থেকে কি পাচ্ছে? অথছ সরকার শিক্ষার মানোন্নয়ন করার লক্ষ্যে শিক্ষাখাতে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ করছে। দেশে অজস্র স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি গড়ে তোলা হচ্ছে, কিন্তু ফলাফল কি আসছে তা সবারই জানা। প্রতি বছর যে সব ছাত্র বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি থেকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভালো রেজাল্ট করে বের হচ্ছে, তাদের মধ্যে আমার মনে হয়, শতকরা ২৫ ভাগ ছাত্র উচ্চতর বড় ডিগ্রি নিয়ে দেশের সেবায় কাজ করছে। আর বাকিরা কোটিপতি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর, অনেকে আবার বিদেশেও পাড়ি দিচ্ছে। এদের মধ্য থেকে যারা রাজনীতিতে যুক্ত হচ্ছে তারাও দেখছে, সহজে কোটিপতি হওয়ার একমাত্র রাস্তা হচ্ছে রাজনীতি। বর্তমান সময়ে রাজনীতিবিদদের মধ্যে একটি বিরাট অংশ এই অপ-রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছে। অর্থাৎ দিন দিন রাজনীতিরও বারোটা বেজে যাচ্ছে।
৪ জুন মঙ্গলবার ’ঢাকার একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার খবরে প্রকাশ, ”পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি পি) বেনজীর আহমেদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের চিত্র উঠে আসছে, তাতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআাইবি)। সংস্থাটি বলছে, উচ্চপর্যায়ের ব্যাক্তিদের ক্ষমতার লাগামহীন অপব্যবহার বেনজীরের মতো দানব তৈরী করেছে, যা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার জবাবদিহি কাঠামোকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ইফতেষারুজ্জামান বলেছেন, বেনজীর এতদিন ধরে দুর্নীতি করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন, অথচ বিষয়িটি সরকারের নজরে আসেনি এমন দাবি মানার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, এমন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, অপরাধ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের একাাংশ শুধু তাকে সুরক্ষা দেয়নি, সহযোগিতাও করেছে, ক্ষেত্রবিশেষে উৎসাহও দিয়েছে ,যা প্রশাসনযন্ত্রে, রাজনৈতিক অঙ্গনের ভিতরে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তৈরীতে অভুতপূর্ব ভুমিকা রাখছে।ক্ষমতার অপব্যবহারে সহযোগী ও সুরক্ষা প্রদানকারীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি।”
এ সব ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পরপরই বেনজির আহমদ স্বপরিবারে দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন। যাওয়ার আগে তিনি হুঁশিয়ারী উচ্চারন করে বলেছেন, ”তোমরা আমার সামান্য সম্পদের খোঁজ পেলেও ব্যাংকে এবং বিদেশে আমার যে অর্থবিত্ত আছে তা কখনই খুঁজে পাবে না। সুতরাং বাড়াবাড়ি করোনা, তাহলে সব ফাঁস করে দেবো”। এ রকম ঔদ্ধ্যত্বপূর্ণ হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেও তিনি কি ভাবে দেশ থেকে পালিয়ে গেলেন, তাকে দেশ থেকে বের না হওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা কেন দেয়া হলো না এ নিয়ে চলছে বিভিন্ন মহলে জল্পনা-কল্পনা।
কথা হচ্ছে, শুধুমাত্র বেনজীর সাহেবই নন, তার মতো শত শত বেনজীর সাহেব বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন ভাবে ব্যাঙ্ক থেকে যে টাকা উঠিয়ে নিয়ে কোটিপতি হচ্ছে তার খবর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পরও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না কেন? তাহাই জনগণের প্রশ্ন। প্রবাদ আছে, শর্ষের মধ্যে যদি ভুত থাকে তাহলে সে ভুত সরাবে কে? দেশের বর্তমান পরিস্থিতি তা-ই বলে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই বাংলাদেশে রাজনীতিবিদ সহ দেশের প্রশাসনের অবস্থা দেখে দু:খ করে বলেছিলেন, ”একটা দেশ স্বাধীন হলে তারা পায় সোনার খনি, আর আমি পেয়েছি চোরের খনি।”
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের উন্নয়নের গতি আরও ত্বরান্বিত করতে বৈদেশিক সাহায্য ও অনুদানপ্রাপ্ত প্রকল্পগুলো দ্রুত সম্পন্ন করতে অতিরিক্ত প্রচেষ্টা চালাতে সকল মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন। দেশের সবাই জানে, দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে তিনি প্রাণপন কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি যদি সবার আন্তরিক সহযোগিতা পেতেন তাহলে আজ দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের ভিন্ন রূপ দেখতে পারতাম।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, দেশের ব্যাঙ্কগুলো থেকে যদি টাকা লুটপাট না হতো তাহলে আজকে বাাংলাদেশের রিজার্ভ কানায় কানায় পূর্ণ থাকতো। দেশে টাকার কোন অভাব থাকতো না। দেশের সর্বক্ষেত্রে উন্নয়নের জোয়ার বয়ে যেতো। যদিও বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী চক্রগুলো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যতোই পোপাগান্ডা বা মিথ্যাচার ছড়াক না কেন, তাতে কেউ পাত্তা দিতো না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশ পরিচালনায় এগিয়ে যেতে হচ্ছে, নদীর ¯স্রোতের উল্টো দিকে নৌকা বেয়ে। তা একমাত্র সম্ভব হচ্ছে, তিনি একজন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ, ভীষণ ধৈর্য্যশীল, ঠান্ডা মাথায় সব ধরণের বাধাকে প্রতিহত করার ক্ষমতা এবং শক্ত হাতে দায়িত্ব পালন করার ক্ষমতা থাকার কারণে। আর এ কারণেই আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলি, একজন ’লৈৗহ মানবী’।
সবশেষে বলবো, বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখে দেশকে নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌছাতে হলে যে ভাবেই হোক, শক্ত আইন করে ব্যাঙ্কগুলো থেকে টাকার চুরির হরিলুট বন্ধ করার পদক্ষেপ নিতে হতে। এদের বিরুদ্ধে কঠোর শস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়াও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সহ যতগুলো জায়গা সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি, সেগুলোকে উদ্ধার করার পদক্ষেপ নিতে হবে।
আজকের এই লেখাটি লিখতে গিয়ে দেশের কিছু সংখ্যক মানুষ অধ:পতনের কোন স্তরে গিয়ে পৌচেছে তা উপলব্ধি করা যায় । কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন- –
এ-দেশের নাড়িতে-নাড়িতে অস্থিমজ্জায় যে পচন ধরেছে, তাতে এর একেবারে ধ্বংস না হলে নতুন জাত গড়ে উঠবে না।
লেখকঃ দেওয়ান ফয়সল, কলামিষ্ট, সিনিয়র সাংবাদিক ও সদস্য লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব।
বিষয়: #করুন #বন্ধ #ব্যাংক #লুটপাট