শুক্রবার ● ৭ জুন ২০২৪
প্রথম পাতা » বিনোদন » সত্যি সত্যি সত্যি
সত্যি সত্যি সত্যি
শশুর বাড়িতে স্ত্রীর সামনে ভাত খাচ্ছিলাম আমার শশুর পিছন থেকে একটা লাথি মেরে বললো “এই হারামজাদাকে ভাত দিয়েছে কে? ওকে এ বাড়ির ত্রিসীমানায় দেখতে চাই না, আবার তো দেখি মাছ মাংস দেওয়া হচ্ছে। ”
আমার স্ত্রী তখন অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিল, শশুরের চিৎকার শুনে আমার স্ত্রীর বড় দুই ভাই খাবার ঘরে প্রবেশ করলো। আমি তখন মাটি হতে উঠে দাঁড়িয়েছি, চোখ দিয়ে অজান্তেই হয়ত পানি বেড়িয়ে গেছে।
” আমার শশুর আবার বললেন, তোকে তো বলে দিয়েছি যে আমার মেয়ে তোর সঙ্গে সংসার করবে না। তাহলে তুই আবারও কোন সাহসে এই বাড়িতে প্রবেশ করো? কলিজা কতবড় হয়েছে? ”
” আমি আস্তে করে বললাম, আপনার মেয়ে তো আমাকে আসতে বলেছে তাছাড়া সাদিয়ার (স্ত্রী) সঙ্গে এখনো আমার ডিভোর্স হয়নি। আর সেজন্য আমার আসার অধিকার আছে এখানে, আপনি শুধু শুধু আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছেন। ”
আমার শশুর তখন বাম হাত দিয়ে আমার বুকের উপর শার্ট ধরে বললো,
” এটা তো কিছুই না, তোকে এখন জুতা দিয়ে পেটাতে পেটাতে বাড়ি থেকে বের করবো। যাতে আর কোনদিন লজ্জায় আর এ বাড়িতে প্রবেশ করতে না পারো। তোর বাবার তখন উচিৎ শিক্ষা হবে। ”
” যেহেতু এটা আপনার বাড়ি তাই আপনার ইচ্ছে মতো সবকিছু করতে পারেন। কিন্তু আমার অন্যায় টা কি জানতে পারি? আমি তো আপনার মেয়ের স্বামী, শরিয়ত মোতাবেক আমাদের দুজনের বিয়ে হয়েছে। হ্যাঁ এটা ঠিক যে বেশ কিছুদিন ধরে একটু ঝামেলা হচ্ছে, কিন্তু তাই বলে তো সম্পর্ক সম্পুর্ণ অস্বীকার করা যায় না। আর আপনার মেয়ে নিজে আমাকে কল দিয়ে আসতে বলেছে, অবশ্য সে যদি না বলতো তবুও আসতাম। ”
এমন সময় সাদিয়া প্রতিবাদ করে বলে উঠলো,
” মিথ্যা কথা, আমি কখন তোমাকে আসতে বলছি বলো তো? শুধু শুধু কেন মিথ্যা কথা বলছো? ”
আমি অবাক হয়ে সাদিয়ার দিকে তাকিয়ে আছি, সাদিয়া একবার আমার চোখের দিকে তাকিয়ে অপরাধীর মতো চোখ নামিয়ে নিল। অথচ আজ সকালে সাদিয়া কল দিয়ে নিজেই আমাকে তার বাসায় আসতে বললো।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে নিজের বিছানায় শুয়ে ছিলাম, তখন সাদিয়া কল দিয়ে বললোঃ-
” কেমন আছো? ”
” আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, যেমনটা কল্পনাও করিনি ঠিক তেমনটা আছি। ”
” আমারও তোমাকে ছাড়া থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে সজীব, কিন্তু বাবার ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছি। তোমাকে ছাড়া নিশ্বাস নিতে যেন কষ্ট হচ্ছে, কি করবো বলে দাও তুমি। ”
” আঙ্কেলকে ভালো করে বোঝাতে পারে এমন কাউকে দরকার, যিনি আমাদের পারিবারিক সব সমস্যার সমাধান করতে পারবেন। ”
” তেমন কেউ নেই সজীব, তবে আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। ”
” কি? ”
” তুমি আমাদের বাড়িতে আসো, তারপর আমরা দুজন মিলে বাবার কাছে ক্ষমা চাইবো। অনুরোধ করে বলবো যাতে আমাদের মনের অবস্থা বুঝতে চেষ্টা করে। ”
” ঠিক আছে আমি তাহলে আসছি। ”
খুলনা থেকে আসতে দুপুর হয়ে গেছে, আর শশুড় সাহেব তখন বাসায় ছিল না। সাদিয়া বললো এত দুর থেকে এসেছো তাই খাবার খেতে বসো। আমি বলেছিলাম সবাই আসুক কিন্তু সাদিয়ার অনুরোধ রাখতে গিয়ে খেতে বসেছিলাম। আর তারপর যে কি হচ্ছে সবাই তো জানতে পেরেছেন।
একই ইউনিয়নের মধ্যে থাকলেও আমাদের গ্রাম ছিল ভিন্ন ভিন্ন। আমার শশুর অনেক আগে থেকে সৌদি আরব প্রবাসী, আর আমার বাবাও বছর দশকে ধরে সৌদি আরব থাকেন। সৌদি আরবে গিয়েই বাবার সঙ্গে সেই দেশে বসেই দুজনের মধ্যে একটা ঝামেলা হয়েছে। শুরুতে তারা একসাথে ছিল, একই কোম্পানির কাজ করতো কিন্তু পরে হঠাৎ করে কি যেন হয়ে গেল। আমার বাবার সাক্ষীতে আমার শশুড়ের জরিমানা হয়েছিল, তার অনেক সমস্যা হলো। তারপর থেকে বাবার সঙ্গে তার রাগারাগি, কিন্তু এসব তো আমি আর সাদিয়া জানতাম না।
সাদিয়া আমাদের মোড়েলগঞ্জ এসএম কলেজে অনার্স করছে, আর আমি খুলনা বিএল কলেজে অনার্স শেষ বর্ষে আছি। মাত্র ছ’মাস আগে আমি আর সাদিয়া বিয়ে করেছি, কারণ সাদিয়ার বাবা আমাদের সম্পর্ক জানতে পারেন। এবং তিনি সেই সময় অনেক বকাবকি করে সাদিয়াকে, সাদিয়া তখন বলে যে ” আমরা নিজেরা বিয়ে করে রাখি, তারপর বাবা দেশে ফিরলে দেখবে সবকিছু মেনে নেবে। ”
কিন্তু কেউ মেনে নেয় নাই, সাদিয়ার বাবা দেশে ফিরেছে মাস খানিক আগেই। এবং তিনি এসেই মেয়ের জন্য ছেলে দেখা শুরু করেছে, তাই সেই সময় সাদিয়া বললো আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে। আর তখন থেকে সাদিয়ার বাবা আমাদের সম্পর্ক ভেঙ্গে দেবার জন্য তৎপর চেষ্টা করছে।
–
- আমি সাদিয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম, তুমি কি আমার সঙ্গে যাবে? তাহলে চলো, আমরা দুজন চলে যাই, আর কখনো এদের কাছে আসবো না।
- কিন্তু সাদিয়া মাথা নিচু করে রইল, তার হয়ে তার বাবা বললো, তোর সাহস কতবড়? তুই আমার সামনে দাঁড়িয়ে আবার আমার মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যাবার কথা বলো?
এ কথা বলে তিনি আবার আমাকে মারতে উদ্ধত হয়ে যান, ঠিক তখনই সাদিয়া তার বাবার হাত ধরে বললোঃ- বাবা ওকে মারার দরকার নেই, আমি ওকে চলে যেতে বলছি। আর কখনো সে আমাদের বাড়িতে আসবে না, তোমার ইচ্ছে মতো সবকিছু হবে।
সাদিয়া আমাকে হাত ধরে টেনে অন্য রুমে নিয়ে এলো, তারপর বললোঃ- আমাকে ক্ষমা করে দিও সজীব। তুমি এখন চলে যাও, তোমাকে আমার পরিবার এভাবে অপমান করবে সেটা সহ্য করতে পারি না। যদি দুজনের মিল কপালে লেখা থাকে তাহলে অবশ্যই একসাথে থাকতে পারবো।
- আমি সাদিয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তোমার চোখ মিথ্যা বলছে। আমাদের হয়তো আর কোনদিন দেখা হবে না তাই না সাদিয়া?
- এভাবে বলছো কেন? দেখ বাবা আর বড় ভাই সবাই আছে এখানে।
- শুধু একটাই আফসোস, তোমার হাতের সাজিয়ে দেওয়া খাবারটাও খেতে পারলাম না।
- তুমি চলে যাও সজীব।
- তোমার বাবার ইচ্ছে যে আমাদের ডিভোর্স হয়ে যাক, আর তুমি তো বললে তার ইচ্ছে মতো সবকিছু হবে। তাহলে কি এটাই শেষ?
- এখন এত কথা বাড়িও না।
- ভালো থেকো সবসময়।
সাদিয়াদের বাসা থেকে বেরিয়ে কোথায় যাবো সেটাই ভাবছিলাম। পাশের গ্রামে আমাদের বাড়ি কিন্তু সেখানে যাওয়া কি ঠিক হবে? বাড়িতে শুধু দাদা দাদি আছে, তাছাড়া শহর থেকে নিজের ব্যবহৃত কাপড় কিছু আনা হয়নি। তারচেয়ে বরং খুলনা ফিরে যাওয়া ভালো হবে, সেখানে গিয়ে পরে চিন্তা করা যাবে।
সাদিয়ার বাবার লাথি খেয়ে মাটিতে পরার সময় বুকের একটু নিচে ব্যথা পেয়েছিলাম। এতক্ষণ সে ব্যথা বেশি বুঝতে পারি নাই, কিন্তু এখন আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমস্ত শরীরে ব্যথা ছড়িয়েছে খুব দ্রুত, একটা মোটরসাইকেল পেয়ে সেটাতে করে বাসস্ট্যান্ডে রওনা দিলাম।
বাসের ভিতরে বসেই বুঝতে পারছি শরীরে ব্যথা খুব মারাত্মক হয়ে যাচ্ছে। ব্যাথার জন্য জ্বর চলে আসছে এমন অনুভব করতে লাগলাম। নিরুপায় হয়ে আমি বাসের মধ্যে হাহুতাশ করে অচেতন হয়ে পরে রইলাম। বাগেরহাট গিয়ে আবার নতুন করে সোনাডাঙ্গার বাসে উঠলাম। ষাট গম্বুজ গিয়ে কিছুটা হুঁশ ছিল কিন্তু তারপর আর মনে নেই।
বাসের লোকের ডাকাডাকিতে যখন চোখ মেলে তাকালাম তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাহিরে তাকিয়ে দেখি সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে চলে এসেছে, তাই তাদের কে সরি বলে নেমে গেলাম। বাসের সেই লোকগুলো একরাশ বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
খালিশপুর যাবার জন্য একটা ইজিবাইকের মধ্যে উঠে বসলাম, গাড়ির মধ্যে আমি ছাড়া কেউ নেই। এখনো পাঁচজন যাত্রী দরকার, তারপর খালিশপুর এর উদ্দেশ্যে ইজিবাইক যাবে। আমি আবারও সেই ইজিবাইকের মধ্যে অচেতন হয়ে পরে রইলাম আর কিছু মনে নেই।
এরপর যখন চোখ মেলে তাকালাম তখন দেখি যে আমি একটা বিছানায় শুয়ে আছি। মিনিট খানিক চারিদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছি এটা হচ্ছে এক হাসপাতাল। কারণ আমার চারিপাশে হাসপাতাল এর সকল নমুনা দেখা যাচ্ছে তবে হাসপাতালের কেবিনে আছি সেটাও বুঝতে পারছি।
একটু পরে একটা নার্স এসে দেখলেন আমার জ্ঞান ফিরেছে, তারপর তিনি তার মোবাইল বের করে কাকে যেন কল দিয়ে আসতে বললেন।
তিনি বললেনঃ- হ্যাঁলো আপা, আপনার রোগীর জ্ঞান ফিরেছে তাই আপনি এখনই আসুন।
আমি ভেবেছিলাম জিজ্ঞেস করবো কিছু, কিন্তু ঠোঁট নেড়ে কিছু বলার শক্তি পাচ্ছিলাম না। শুধু মাত্র চেয়ার থেকে লাথির আঘাতে পরে গিয়ে যে এতটা মারাত্মক সমস্যা হবে ভাবিনি। তবে বেশি সমস্যা হয়েছে শীতের কারণে, শীতের দিনে সব সময় আঘাতের ব্যথা কমতে চায় না। তারমধ্যে আবার আমি ছিলাম শীতের পোশাক ছাড়া।
প্রায় আধা ঘণ্টা পরে একটা মেয়ে কেবিনের মধ্যে প্রবেশ করলো, আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি। মনে হচ্ছে তার মুখটা আমার পরিচিত, কিন্তু সেই পরিচিত মুখটা মনে করতে পারি নাই।
- মেয়েটা বললো, কেমন আছেন এখন?
- আমি ‘ভালো আছি’ বলতে গিয়ে আবার বলতে পারি নাই কিন্তু সে বুঝতে পেরেছে ইশারায়।
- বললো, আপনাকে নিয়ে গতকাল রাতে খুব টেনশনে পরে গেছিলাম। সবাই যে যার মতো করে চলে গেছে কিন্তু আমি অনেক কষ্টে একজন রিক্সা ওয়ালার সাহায্য হাসপাতালে আসলাম।
- আমি চুপচাপ।
- আপনি বুঝতে পারছেন আমার কথা?
- আমি মাথা নাড়িয়ে “হ্যাঁ” বললাম।
- আপনার কাছে আমার একটা গভীর প্রশ্ন ছিল।
- আমি তাকিয়ে আছি।
- মেয়েটা তার হাতের কাগজের ভাজ খুলে দিয়ে আমার দিকে দেখিয়ে বললোঃ- আপনার পকেট চেক করে ঠিকানা বের করতে গিয়ে একটা হাতে আকা ছবি পেলাম। এ পেন্সিলে আকা ছবিটা কি আপনি এঁকেছেন?
- হ্যাঁ।
- আপনি কি আমাকে আগে কখনো দেখেছেন?
- জ্বি না।
- এই ছবিটির সঙ্গে আমার চেহারার সম্পুর্ন মিল আছে সেটা লক্ষ্য করেছেন?
আমি এবার চোখ বড় বড় করে তাকালাম, আর তার হাতের ছবিটা ও তার দিকে তাকিয়ে আছি। আরে সত্যি সত্যি তো, এটা কীভাবে সম্ভব?
- মেয়েটা বললো, আপনি যদি আমাকে কখনো না দেখেন তাহলে আপনি কীভাবে আঁকলেন? আর আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, আপনি ছবির নিচে নাম লিখেছেন “বৃষ্টি”।
- বললাম, হ্যাঁ বৃষ্টি নাম দিয়েছি ছবিটির।
- আপনি কি জানেন আমার নাম নাজমা আক্তার বৃষ্টি?
- আমি বললাম, না আগে জানতাম না।
বিষয়: #সত্যি