

সোমবার ● ৩ মার্চ ২০২৫
প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » ছেলেকে বিদায় জানাতে এসে আগুনে চিরবিদায় নিলেন বাবা
ছেলেকে বিদায় জানাতে এসে আগুনে চিরবিদায় নিলেন বাবা
রাজধানীর শাহজাদপুরের বীর উত্তম রফিকুল ইসলাম এভিনিউর মজুমদার ভিলার আবাসিক হোটেলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় চারজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় আরও দুজন আহত হয়েছেন। আহতদের দ্রুত উদ্ধার করে নিকটস্থ হাসপাতালে পাঠানো হয়। তবে আহতদের বিষয়ে এখনো বিস্তারিত কোনো তথ্য জানাতে পারেনি পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস।
ঘটনাস্থলের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এবং মরদেহের সুরতহাল শেষে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের প্রাথমিক ধারণা, নিহত চারজন আগুনে সৃষ্ট ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মারা যান। প্রাথমিকভাবে নিহতদের মধ্যে একজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তিনি আজ সোমবার সকাল ৮টার দিকে হোটেলটিতে ওঠেন।
সোমবার (৩ মার্চ) বেলা ৩টার দিকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
ছেলেকে বিদায় জানাতে এসে চির বিদায় নিলেন বাবা
পুলিশ জানিয়েছে, নিহত যে ব্যক্তির পরিচয় জানা গেছে তার নাম মিরন জম্মাদার (৬০)। তার বাড়ি পিরোজপুর জেলায়। তিনি আজ সকাল আটটায় হোটেলটিতে উঠেন।
নিহতর আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিরনের ছেলে মুবিন জমাদ্দার আগামীকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যার একটি ফ্লাইটে সৌদি আরবে যাওয়ার কথা। মুবিন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছাকাছি একটি এলাকায় হোটেলে উঠেন। আর বাবা মিরন বিমানবন্দরে যেতে যাতে সুবিধা হয় তাই শাহজাদপুরের সৌদিয়া নামের হোটেলটিতে ওঠেন।
মিরন আজ তার বোনের স্বামী হিরন তালুকদারের সঙ্গে পিরোজপুর থেকে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় এসে তিনি আজ সকাল ৮টায় হোটেলটিতে উঠেন। হোটেলে উঠার পর তিনি আবার বাইরে বের হন, নাস্তা করেন একটি দোকানে। নাস্তা শেষে হোটেলে ফিরে যান বিশ্রাম নিতে।
এরই মধ্যে আগুন লাগে। আগুন লাগার পর কোথাও বের হতে না পেরে জীবন বাঁচানোর জন্য ফোন দেন বোনের স্বামী হিরনকে। হিরনকে ফোন দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মিরন বলেন, আমি বাঁচার কোনো পথ পাচ্ছি না, চারদিকে ধোঁয়া, দম বন্ধ হয়ে আসছে। এই কথা বলার পরে ফোন কেটে যায় মিরনের। পরে ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণের পর মিরনের মরদেহ চারতলা থেকে উদ্ধার করে।
নিহতের বোনের স্বামী হিরন তালুকদার বলেন, আমরা আজ সকালে এসে হোটেলটিতে উঠি। মিরন জমাদ্দারের ছেলে মুবিন জমাদ্দার আগামীকাল সৌদি আরবে যাবেন সন্ধ্যার ফ্লাইটে। তাকে বিদায় দিতে আমরা আজ সকালে আসি। সকালে আসার পর তিনি হোটেলের পাশে একটি রেস্টুরেন্ট থেকে নাস্তা করে হোটেলে যান এবং আমাকে বলেন আপনি নাস্তা করে আসেন আমি একটু রেস্ট নেই। এর কিছুক্ষণ পর আগুন দেখে হোটেলের নিচে দৌড়ে আসি। এসে দেখি সারা হোটেল আগুনে ধোঁয়াছন্ন। তখনই মিরন আমাকে ফোন দিয়ে বলে চারদিকে ধোঁয়া, উনি কোথাও যাওয়ার জায়গা পাচ্ছেন না, আর তখন তিনি কান্না করছেন। তিনি হোটেলের চারতলার রুমে ছিলেন। রুম নম্বর ৪০২।
সরেজমিন দেখা গেছে, যে ভবনটিতে আগুন লাগে সে ভবনটি ছয়তলা বিশিষ্ট। নিচ তলায় তিনটি দোকান রয়েছে, দুই তলায় মেয়েদের একটি বিউটি পার্লার ও তিনতলা থেকে ছয় তলা পর্যন্ত সৌদিয়া হোটেল। তবে ভবনটির ছয় তলার অর্ধেক হোটেল রুম আর বাকি অর্ধেক ছাদ। ভেতরে দেখা যায়, শুধুমাত্র দুই তালায় বিউটি পার্লার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এছাড়া ভবনের নিচতলা আংশিকভাবে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে তৃতীয় তলা থেকে ছয় তলা পর্যন্ত যেখানে হোটেল অবস্থিত সেখানে আগুনের ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
ছাদের দরজা বন্ধ থাকায় ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মারা যান চারজন
ভবনের নিচ তলায় আছে রুমা ডিজিটাল নামে একটি স্টুডিও। এছাড়া রয়েছে মা ডোর সেন্টার এন্ড ফার্নিচার ও মুন্নি এন্টারপ্রাইজ নামে দুইটি দোকান ও দ্বিতীয় তলার পার্লারটির নাম গোল্ডেন টিইউলিপ। এরপর তিন তলা থেকে ছয় তলার অর্ধেক পর্যন্ত রয়েছে হোটেল সৌদিয়া।
ভবনটির চারতলায় হোটেল রুমের সামনে একটি মরদেহ পড়ে রয়েছে। অন্যদিকে ভবনের ছয়তলার ছাদের সামনের গেটের সামনে বাকি তিনটি মরদেহ পড়ে রয়েছে। ভবনের ভেতরে বিভিন্ন ফ্লোরে কাঁচের ভাঙ্গা টুকরো পড়ে থাকতে দেখা যায়। তবে দ্বিতীয় তালার পার্লারটি পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস বলছে, ভবনের চারতলায় যে মরদেহ পাওয়া যায় সেটি আসলে একটি বাথরুম থেকে পাওয়া যায়। বাকি তিনটি মরদেহ ছয় তলার ছাদের গেটের সামনে পড়ে ছিল। ছাদের গেটটি তালাবন্ধ ছিল।
এ বিষয়ে ডিএমপির গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোখলেছুর রহমান বলেন, ভবনটির চারতলা থেকে একজনের ও ছয় তলার ছাদের গেট থেকে তিনজনের মরদেহ পাওয়া গেছে। মরেদেহগুলো আগুনের তাপে কিছুটা পুড়ে গেছে; তবে বাকি শরীর ঠিকঠাক রয়েছে। আমাদের প্রাথমিক ধারণা এ চারজন আগুনের সৃষ্ট ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। আমরা এখন পর্যন্ত একজনের পরিচয় নিশ্চিত করতে পেরেছি। বাকি তিনজনের মরদেহ জানা যায়নি। আমাদের ধারণা এ চারজন হোটেলের গেস্ট ছিলেন।
তিনি আরও বলেন, ঘটনাস্থলে এসে বিউটি পার্লারের এবং হোটেলের কাউকে পাওয়া যায়নি। আমরা অনেক খোঁজাখুঁজির পরও এই দুই প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্তৃপক্ষকে বা কর্মচারীকে পায়নি।
আগুনের সূত্রপাত নিয়ে যা বলছে প্রত্যক্ষদর্শীরা
প্রত্যক্ষদর্শী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বলছেন, আগুনের সূত্রপাত ঘটে দ্বিতীয়তলার বিউটি পার্লার থেকে। পরে বিউটি পার্লার থেকে আগুন বাড়তে থাকে আর প্রচণ্ড ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়।
এ বিষয়ে ভবনটির নিচতলার মা ডোর সেন্টার অ্যান্ড ফার্নিচারের মালিক ফারুক হোসেন জানান, আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে দোকানের ক্যাশবাক্স নিয়ে বের হয়ে যান। আল্লাহর রহমতে আমার দোকানে তেমন ক্ষতি হয়নি। তবে দুই তালার বিউটি পার্লার থেকে আগুনটা সৃষ্টি হয়। সেখানে এসি থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটে শুনেছি। এরপর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আসেন আগুন নেভান। কিন্তু আগুনে প্রচণ্ড ধোঁয়ার সৃষ্টি হয় যা ওপরের দিকে চলে যায়।
পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের ধারণা, চারতলার বাথরুমে যে মরদেহটি পাওয়া যায় সেই ব্যক্তি হয়ত জীবন বাঁচাতে পানির জন্য বাথরুমের ভেতরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আর বাকি তিনজন জীবন বাঁচাতে ছাদে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ছাদ বন্ধ থাকায় তারা আর যেতে পারেনি সেখানেই ধোঁয়ার কারণে দম বন্ধ হয়ে মারা যান।
এর আগেও আগুন লেগেছিল ভবনটিতে, ছিল না কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা
প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভবনটিতে ছয়-সাত মাস আগে আরও একবার আগুন লেগেছিল। তখন কোনো প্রাণহানি না ঘটলেও আগুনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল ভবনটিতে।
স্থানীয় বাসিন্দা মুন্না রহমান বলেন, ভবনটিতে ৬-৭ মাস আগেও একবার আগুন লেগেছিল। ভবনটির অবস্থা খুবই খারাপ। এখানে এমন সরু সিঁড়ি যে আগুন লাগলে কোনো মানুষ দ্রুত বের হয়ে যে প্রাণ বাঁচাবে সেই ব্যবস্থাও নেই।
আগুন নির্বাপণের পর ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিস ঢাকা জোনের সহকারী পরিচালক কাজী নজমুজ্জামান বলেন, আগুন লাগার ১০ মিনিটের মধ্যে আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। এসে দেখলাম আগুন লাগা ভবনটি ছয়তলা। নিচতলা হার্ডওয়্যারের দোকান, দ্বিতীয় তলায় বিউটি পার্লারের দোকান, তৃতীয় তলা থেকে ছয়তলা পর্যন্ত আবাসিক ভবন। দুইতলায় প্রচণ্ড আগুন এবং ধোঁয়া ছিল। ঘটনাস্থলে পৌঁছে মোট চারটি ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট কাজ করে। প্রায় ৩০ মিনিটের মধ্যে আমরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। প্রচণ্ড ধোঁয়া বের হতে না পেরে ওপরে ধোঁয়া উঠে যায়।
ভবনটির চিলেকোঠায় তিনজনের মরদেহ পায় এবং একজনকে বাথরুম থেকে উদ্ধার করা হয় জানিয়ে ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা বলেন, ছাদে যাওয়ার জন্য চিলেকোঠার দরজা বন্ধ ছিল। অর্থাৎ প্রচণ্ড ধোঁয়ার কারণে আবাসিক হোটেলের ভেতরে যারা ছিল তারা বাঁচার জন্য ওপরের দিকে উঠে যায়। ওপরে উঠতে গিয়ে তারা দেখতে পান ছাদের দরজা বন্ধ আছে।
এরপর তারা আর সেখান থেকে বের হতে পারেননি। এজন্য ধোঁয়ার কারণে চারজনের মৃত্যু হয়। চারজনকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। চারজনের মরদেহ ছাড়া দুজনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।
অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগুনের কারণ এখনই বলা যাচ্ছে না। মালিক কর্তৃপক্ষের কাউকে আমরা পায়নি। কমিটি গঠনের পর তদন্ত করে আগুনের প্রকৃত কারণ নির্ণয় করা হবে।
ভবনটি নিয়ম মেনে তৈরি করা হয়েছে কি না এবং পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল কি না জানতে চাইলে সহকারী পরিচালক কাজী নজমুজ্জামান বলেন, রাজউকের নিয়ম অনুযায়ী বিল্ডিংটি তৈরি করা হয়নি। ভবনটিতে কোনো ফায়ার সেফটি প্ল্যান ছিল না এবং অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না। সিঁড়িগুলো ছিল সরু। সিঁড়ির পাশে যে জানালা ছিল সেগুলো কাচ দিয়ে বন্ধ করা ছিল। কাচ দিয়ে বন্ধ না থাকলে ধোঁয়া বের হয়ে আসতে পারতো।
বিষয়: #আগুনে #এসে #চিরবিদায় #ছেলেকে #জানাতে #নিলেন #বাবা #বিদায়
