

বুধবার ● ১২ মার্চ ২০২৫
প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » একজন দূরদর্শী নেতা সৈয়দ মনজুর এলাহীর প্রয়াণ
একজন দূরদর্শী নেতা সৈয়দ মনজুর এলাহীর প্রয়াণ
সৈয়দ মিজান ::
এপেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী কালের গণ্ডি পেরিয়ে চলে গেলেন অনন্তের পথে; রেখে গেলেন দূরদর্শিতা ও সততার মিশেলে বোনা এক অনন্য উত্তরাধিকার। শোকসন্তপ্ত আমরা তার অসাধারণ নেতৃত্বের কাছে চিরঋণী। আমরা তার চিরশান্তি কামনা করি। মহান আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন।
তার প্রথম জানাজা নামাজ ১৩ মার্চ ২০২৫ সকাল ১০:৩০টায় ঢাকার ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি প্রাঙ্গণে এবং দ্বিতীয় জানাজা জোহরের পর ঢাকার গুলশান-২ আজাদ মসজিদে অনুষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশ অসামান্য এক শিল্পপতিকে হারালো। এপেক্স ফুটওয়্যার, এপেক্স ট্যানারি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, পায়োনিয়ার ইন্স্যুরেন্স, গ্রে অ্যাডভার্টাইজিং বাংলাদেশ লিমিটেড, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান তিনি গড়ে তুলেছেন।
১৯৪২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিশিষ্ট আইনজ্ঞের পরিবারের সন্তান ছিলেন। তাঁর পিতা, স্যার সৈয়দ নাসিম আলী, অবিভক্ত বাংলার প্রধান বিচারপতি ছিলেন। তিনি চাইলে একই পথে হেঁটে আইন ও প্রশাসনের গম্ভীর অঙ্গনে প্রবেশ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি বেছে নিয়েছিলেন দেশীয় শিল্প বিকাশের পথ। কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে শিক্ষা সম্পন্ন করে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে, তিনি ব্যবসার জগতে পা রাখেন।
তিনি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোতে কর্মজীবন শুরু করেন, কিন্তু শীঘ্রই চাকরির নিরাপত্তার পরিবর্তে উদ্যোক্তার অনিশ্চয়তাকে বেছে নেন। ঢাকা ও প্যারিসের মধ্যে চামড়া বাণিজ্যের সূত্র ধরে এক ফরাসি ব্যবসায়ী তাঁকে চামড়া শিল্পে পদার্পণের সুযোগ করে দেন। গড়ে উঠে এপেক্স; বিস্তৃত হয় তাঁর বিবিধ শিল্প প্রতিষ্ঠান।
এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে, তিনি এপেক্সকে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম জুতা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। তিনি এপেক্স ট্যানারি লিমিটেড, পায়োনিয়ার ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের নেতৃত্ব দিয়ে দেশীয় শিল্পের অগ্রযাত্রাকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যান। তাঁর প্রভাব বাণিজ্যের বাইরেও বিস্তৃত ছিল। তিনি এপেক্স এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, গ্রে অ্যাডভার্টাইজিং বাংলাদেশ লিমিটেড, ব্লু ওশান ফুটওয়্যার লিমিটেড এবং কোয়ান্টাম কনজিউমার সলিউশন লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি এপেক্স ফার্মা লিমিটেড, এপেক্স ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, সানবিমস স্কুল লিমিটেড, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সভাপতিত্ব করেন। তাঁর প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা ইন্টারন্যাশনাল পাবলিকেশন্স লিমিটেড (দ্য ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসের প্রকাশক), ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি অফ বাংলাদেশ (সিআরএবি), সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি), বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশন এবং ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে পথ দেখিয়েছে।
জাতির ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে দেশকে স্থির রাখার জন্য তাঁকে দুইবার আহ্বান জানানো হয়। দুইবারই তিনি সাড়া দিয়েছেন। ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে, তিনি দৃঢ়তার সাথে সরকার পরিচালনায় অংশ নেন। তিনি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ ব্যাংকস (বিএবি), সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজ (বিএপিএলসি)-এর ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোতে তাঁর অবদান বিস্তৃত ছিল। মেট্রোপলিটন চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) এবং বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিইএ)-এর সভাপতি হিসেবে, তিনি জাতীয় অর্থনৈতিক নীতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
তাঁর নেতৃত্ব তাঁকে ব্যবসায়িক জগতে সর্বোচ্চ সম্মান এনে দিয়েছে। আমচ্যাম কর্তৃক “বিজনেস এক্সিকিউটিভ অফ দ্য ইয়ার ২০০০”, দ্য ডেইলি স্টার এবং ডিএইচএল কর্তৃক “বিজনেস পারসন অফ দ্য ইয়ার ২০০২” এবং ২০২৩ সালে ২১তম ডিএইচএল-ডেইলি স্টার বাংলাদেশ বিজনেস অ্যাওয়ার্ডে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত হন তিনি। কিন্তু পুরস্কার কখনোই তাঁর লক্ষ্য ছিল না। তিনি স্বীকৃতির জন্য নয়, টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনুগামী ছিলেন।
২০২০ সালে শোক এসে হানা দেয় তাঁর পরিবারে। তাঁর জীবনসঙ্গী, সানবিমস স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা নিলুফার মঞ্জুরকে মহামারী কেড়ে নেয়। নিলুফার মঞ্জুর ছিলেন জয়পুরহাটের প্রাক্তন সংসদ সদস্য মফিজ চৌধুরীর কন্যা।
অন্যান্য বিশিষ্ট ভূমিকার মধ্যেও তাঁর পুত্র, সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর ল্যান্ডমার্ক ফুটওয়্যার লিমিটেড এবং পায়োনিয়ার ইন্স্যুরেন্স কোং লিমিটেডের চেয়ারম্যান হিসেবে পারিবারিক উত্তরাধিকার বহন করছেন। তাঁর কন্যা, মুনিজ মঞ্জুর সানবিমস স্কুল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন এবং এপেক্স গ্রুপের বিভিন্ন কমিটিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছেন।
আজ তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন গল্প তার শেষ অধ্যায়ে পৌঁছালেও তাঁর কিংবদন্তি শেষ হয়নি; বরং প্রতিধ্বনিত হচ্ছে দেশে, বিদেশে; তাঁর গড়ে তোলা সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর মতো এমন এক অনবদ্য ব্যক্তিত্ব শুধুমাত্র ব্যক্তিগত অর্জনে নয়; সামগ্রিক সমৃদ্ধির স্বপ্নদ্রষ্টা হয়ে বেঁচে আছেন বাংলাদেশের বহু বহু মানুষের হৃদয়ে। বাংলাদেশ এই অনন্য শিল্পপতিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে ।
বিষয়: #একজন #এলাহী #দূরদর্শী #নেতা #প্রয়াণ #মনজুর #সৈয়দ