

বুধবার ● ২৬ মার্চ ২০২৫
প্রথম পাতা » কবি ও কবিতা » শহিদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা
শহিদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা
-বিচিত্র কুমার
১৯৭১ সালের এক গভীর রাত। ঢাকার আকাশে তখন ভয় আর আতঙ্কের অন্ধকার। বাতাসে বারুদের গন্ধ, চারদিকে গুলির শব্দ আর মানুষের আর্তনাদ। রফিক সাহেব জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলেন, পাক হানাদার বাহিনীর গাড়িগুলো একে একে ঢুকে পড়ছে শহরের অলিগলিতে। কিছুক্ষণ পরেই পাশের বাড়ির করুণ চিৎকার শোনা গেল। তাঁর বুক কেঁপে উঠল। এই কি সেই দেশ, যে দেশের জন্য লক্ষ প্রাণ আত্মাহুতি দিচ্ছে? এই কি সেই স্বাধীনতা, যার জন্য তার বড় ছেলে আনোয়ার অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে?
রফিক সাহেব একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। বয়স ষাটের কোঠায়। স্বাধীনতার আন্দোলনের প্রতি তার প্রবল আগ্রহ ছিল, কিন্তু একমাত্র সন্তান আনোয়ার যখন যুদ্ধে যাওয়ার কথা বলেছিল, তখন তার মন সায় দেয়নি। তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, “তোর মা খুব অসুস্থ, আমি বৃদ্ধ মানুষ, তুই যদি যুদ্ধে চলে যাস, আমরা কীভাবে বাঁচব?” কিন্তু আনোয়ার চোখে অদম্য আগুন নিয়ে বলেছিল, “বাবা, দেশটাই যদি না থাকে, তাহলে আমাদের বেঁচে থাকাটা কী অর্থ বহন করবে?”
এরপর একদিন আনোয়ার বাসা থেকে বেরিয়ে আর ফেরেনি। শুধু একটা চিঠি রেখে গিয়েছিল—
“বাবা, আমায় ক্ষমা করো। মা’কে বলো আমি দেশের জন্য লড়াই করতে গেছি। যদি বেঁচে থাকি, একদিন বিজয়ের পতাকা হাতে ফিরে আসব।”
সেই থেকে রফিক সাহেব শুধু ছেলের অপেক্ষায় দিন কাটাতে লাগলেন। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে দোয়া করতেন, যেন আনোয়ার সুস্থ থাকে, যেন সে ফিরে আসে। কিন্তু সময় গড়িয়ে যেতে লাগল, কোনো খোঁজ মিলল না।
অন্যদিকে, আনোয়ার তখন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। প্রথমে মিরপুরের এক গোপন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়েছে, তারপর সীমান্ত পেরিয়ে চলে গেছে আগরতলা। সেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়েছে। রাইফেল চালানো, গ্রেনেড নিক্ষেপ করা, শত্রুর ঘাঁটিতে হানা দেওয়া—সব কিছুরই হাতেকলমে শিক্ষা পেয়েছে সে। তিন মাসের প্রশিক্ষণ শেষে সে একদল মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে ফিরে আসে ঢাকায়। এবার তাদের লক্ষ্য ছিল মিরপুরের রাজাকারদের ঘাঁটি ধ্বংস করা।
নভেম্বরের এক শীতল রাতে তারা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। অতর্কিত আক্রমণে রাজাকারদের পরাস্ত করতে সক্ষম হয় তারা। কিন্তু দুর্ভাগ্য, পাক সেনারা পাল্টা হামলা চালায়। প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে আনোয়ার গুলিবিদ্ধ হয়, কিন্তু সে পিছু হটেনি। গুলির আঘাত উপেক্ষা করে সে সামনে এগিয়ে গিয়ে শত্রুর বাংকার লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুড়ে মারে। মুহূর্তেই বিকট বিস্ফোরণে গোটা এলাকা কেঁপে ওঠে। শত্রুরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়, কিন্তু আনোয়ার আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। রক্তাক্ত শরীর নিয়ে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
তার সহযোদ্ধারা তাকে বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে, কিন্তু পাক সেনাদের অতর্কিত গুলিবর্ষণে সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। শেষ মুহূর্তে আনোয়ারের ঠোঁটে একটুখানি হাসি ফুটে ওঠে। তার কানে যেন অনাগত বিজয়ের জয়ধ্বনি বাজছিল।
পরদিন, পাকিস্তানি বাহিনী তাকে আটক করে নিয়ে যায়। অকথ্য নির্যাতনের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
১৬ ডিসেম্বর—সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যেদিন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাক সেনারা আত্মসমর্পণ করল। চারদিকে উল্লাসের জোয়ার। “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু!” স্লোগানে আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠল। রফিক সাহেব রেডিওর খবর শুনে কেঁদে ফেললেন। দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু তার আনোয়ার আর ফিরে আসবে না!
কয়েকদিন পর এক মুক্তিযোদ্ধা এসে জানাল, আনোয়ারকে ধরা হয়েছিল, নির্যাতন করা হয়েছিল, তারপর হত্যা করা হয়েছিল। শহরের অজ্ঞাত কোনো গণকবরে তার দেহ সমাধিস্থ হয়েছে।
রফিক সাহেব ছেলের রক্তমাখা খাকি পোশাকটি বুকে চেপে ধরলেন। চোখ দিয়ে অবিরাম জল ঝরছে, কিন্তু তার হৃদয়ের গভীরে তখন একটাই প্রতিজ্ঞা—এই দেশের মাটির জন্য যে জীবন উৎসর্গ করেছে, সে কখনো হারিয়ে যাবে না। আনোয়ারের রক্ত বৃথা যায়নি।
বছর ঘুরে আসে বিজয়ের দিন। আনোয়ারের কবরের পাশে মানুষ ফুল রেখে যায়, শিশুরা আসে তার আত্মত্যাগের গল্প শুনতে। দেশ এগিয়ে যায়, সূর্য ওঠে, সময় বদলায়। কিন্তু শহিদদের স্মৃতি অমলিন থাকে চিরকাল।
শহিদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
দুপচাঁচিয়া,বগুড়া।
বিষয়: #প্রতি #বিনম্র #শহিদ #শ্রদ্ধা
